ভারতের আসামে মুসলিমবিরোধী ‘উচ্ছেদ অভিযানের’ পেছনে কী?

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে সম্প্রতি এক মুসলিম ব্যক্তি পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মুসলিম-সংক্রান্ত বিতর্কিত অবস্থান ফের আলোচনায় এসেছে।
গত সপ্তাহে গোলপাড়া জেলার পাইকান সংরক্ষিত বন এলাকায় এই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় এবং সেখানেই প্রাণহানির এই ঘটনা ঘটে।
আসাম পুলিশ ও বন বিভাগ যৌথভাবে ওই এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালায়। স্থানীয় প্রশাসনের ভাষায়, অভিযানে “বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী” অবৈধ বাসিন্দাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু বাস্তবে যাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তারা অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম, যারা বহু বছর ধরে সেখানে বসবাস করে আসছেন।
স্থানীয় গণমাধ্যম মাকতুব মিডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুলিশের গুলিতে এক মুসলিম ব্যক্তি নিহত হন এবং আরও একজন গুরুতর আহত হন। আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের গৌহাটির হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
— TRT World (@trtworld) March 15, 2025
সরকারি হিসেবে বলা হচ্ছে, সংরক্ষিত বনভূমির ১৪০ হেক্টর জমি খালি করা হচ্ছে। কিন্তু এই অভিযানে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮০টি পরিবার, যাদের অধিকাংশই বাঙালি মুসলমান।
অবশ্য এই ধরনের উচ্ছেদ অভিযান এবারই প্রথম নয়। ঠিক এক মাস আগেই গত ১৬ জুন, গোলপাড়ার কাছাকাছি হাসিলাবিল নামের জলাভূমি এলাকায় ৬৯০টি পরিবারের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সেখানেও প্রধানত বাঙালি মুসলিমদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে অভিযানে টার্গেট করা হয়।

মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে লিখেছেন: “উচ্ছেদ চলতেই থাকবে। আমাদের বনভূমি ও ভূমির ওপর স্থানীয় অধিকার রক্ষার কাজ চলতেই থাকবে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চলতেই থাকবে।”
— TRT World Now (@TRTWorldNow) February 11, 2025
কিন্তু এই “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী” তত্ত্ব নিয়ে বহুদিন ধরেই প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার এখন এই ব্যাখার আড়ালে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে উচ্ছেদ বা ‘বুলডোজার জাস্টিস’ চালাচ্ছে।
গত বছরই দিল্লিতে একটি শতাব্দী প্রাচীন মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়, যা আসলে ভারত রাষ্ট্র গঠনের আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অথচ এটিকেও বনভূমি পুনর্দখলের নামে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
হিমন্ত শর্মার মুসলিম-বিরোধী অবস্থান
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। তিনি বাঙালি মুসলিমদের “বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী” বলে অভিযোগ করে থাকেন। ২০২৩ সালের আগস্টে তিনি বলেন, “আমি পক্ষ নেব। এটাই আমার আদর্শ।”
তিনি এমনকি সবজির মূল্যবৃদ্ধি ও রাজ্যে বন্যার জন্যও মুসলিমদের দায়ী করেছেন, যা পরে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সংগঠনের মুসলিমদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়ার পথ প্রশস্ত করেছে।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি চান ভারত সফরে বাইডেন প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ভারতের মুসলিমদের সুরক্ষা নিয়ে কথা বলুন।
জবাবে শর্মা বলেছিলেন, “ভারতে অনেক ‘হুসেইন ওবামা’ আছে, আসাম পুলিশ তাদের দেখবে।”
তার এই মন্তব্যকে মুসলিম বিদ্বেষপূর্ণ বলে সমালোচনা করেন বিরোধীরা। কংগ্রেস নেত্রী সুপ্রিয়া শ্রীনেট বলেন, এটি “স্পষ্ট ইঙ্গিত যে ওবামার মুসলিম পরিচয় তুলে ধরে ভারতের মুসলিমদের শাস্তি দেওয়ার হুমকি।”
তৃণমূল সংসদ সদস্য সাকেত গোখলে একে “আসাম পুলিশ ব্যবহার করে ভারতীয় মুসলিমদের ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা” বলে উল্লেখ করেন।
কী ঘটতে পারে সামনে?
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা জানিয়ে দিয়েছেন, এই উচ্ছেদ থামবে না। গত ৮ জুলাই তিনি বলেন, “যদি ৩৫০ জন অবৈধ বাংলাদেশিকে তাড়ানো নিয়ে কারও সমস্যা থাকে, তাহলে সেটা ওদেরই সহ্য করতে হবে।”
আরও পড়ুন
তবে বাস্তুচ্যুত বহু পরিবার ইতোমধ্যে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম স্ক্রল.ইন-এর মতে, গত এক মাসে আসামের চার জেলায় অন্তত পাঁচটি বড় উচ্ছেদ অভিযানে ৩ হাজার ৫০০ পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। মল্লিকার্জুন খাড়গে ও রাহুল গান্ধীর মতো কংগ্রেস নেতারাও এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া আরও বড় আকারে সহিংসতা বা প্রতিবাদের জন্ম দিতে পারে।
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড
টিএম