সাঁজোয়া ট্রেনে চেপে চীনে কিম, কেন গুরুত্বপূর্ণ এই সফর

সাঁজোয়া ট্রেনে চেপে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে পৌঁছেছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি উপলক্ষে চীনের আয়োজিত সামরিক কুচকাওয়াজের এক দিন আগে মঙ্গলবার বেইজিংয়ে পৌঁছেছেন তিনি। সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠক করার কথা রয়েছে কিম জং উনের।
২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে একেবারে অল্প কয়েকটি সফরে বিদেশ গেছেন কিম জং উন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তিনি গেছেন চীনে। অতীতে অন্তত চার বার বেইজিং সফর করেছেন তিনি। আর রাশিয়া সফর করেছেন মাত্র দু’বার।
সবচেয়ে বিরল ও ব্যতিক্রমী এক সফরে সাত বছর আগে ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুর সফরে গিয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার নেতা। ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে বৈঠক করেন। এরপর ২০১৯ সালের শুরুর দিকে হ্যানয়ে তাদের মাঝে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তের যৌথ নিরাপত্তা অঞ্চলেও দু’বার সফরে যান কিম।
কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত দ্বিপাক্ষিক আয়োজনের অংশ হিসেবে এসব সফর করেন কিম জং উন। সব সফরের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তিনি। কিন্তু বুধবার তিনি নিজেকে দেখতে পাবেন বিশ্ব নেতাদের ভিড়ে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) ক্রিস্টোফার গ্রিন বলেন, ‘‘এটি এক অস্বাভাবিক ঝুঁকি।’’
তিনি বলেন, সাধারণত বহুপাক্ষিক কোনও অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার রেওয়াজ আছে কিম জং উনের। কারণ সেখানে রাজনৈতিক বার্তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এখন উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তারা এটি কীভাবে সামলান, সেটি দেখতে হবে।
ক্রিস্টোফার গ্রিন বলেন, চীনে ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাঙ্ক আর যুদ্ধবিমানে ঠাসা কুচকাওয়াজে কিম, শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উপস্থিতি প্রবল প্রতীকী বার্তা বহন করছে; মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক ব্যবস্থায় বিকল্প এক চিত্র।
সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির জেমস চার বলেন, বুধবার বেইজিংয়ের প্রচারণার মূল লক্ষ্য জাপান এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লকও। কিমের উপস্থিতি একে ‘ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্টের’ রূপ দিচ্ছে।
এই সফর কিমের জন্য দেশীয় রাজনীতিতেও বড় ধরনের সাফল্যের বার্তা দিচ্ছে। কারণ এর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার জনগণকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন দেশটি যে দুই বিশ্বশক্তি চীন ও রাশিয়ার কাছে সম্মানিত, সেটিও জনগণের কাছে তুলে ধরছে। দেশে বড় ধরনের সামরিক কুচকাওয়াজে কিমের উপস্থিতি বেশ পরিচিতই। প্রথমবারের মতো অন্য দেশের এমন বৃহৎ অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন তিনি।
১৯৪৫ সালে উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্র ছিল না। দেশটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। কিম জং উনের দাদা কিম ইল সুং মানচুরিয়ায় জাপানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। জাপানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে কোরীয়দের অবদান আজও চীনের সঙ্গে এক ধরনের ভাগাভাগির সামরিক স্মৃতি তৈরি করে।
তবে এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আড়ালে বেইজিং ও পিয়ংইয়ংয়ের সম্পর্ক আসলে অস্বস্তিকর। আইসিজির গ্রিন বলেন, চীন ও উত্তর কোরিয়া বন্ধুও নয় এবং সত্যিকারের মিত্রও নয়। বিষয়টির ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, চীন উত্তর কোরিয়ার অস্তিত্বকে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার, একটি বাফার রাষ্ট্র এবং সস্তা শ্রমের উৎস হিসেবে মনে করে।
কিমের শাসনব্যবস্থার প্রতি চীনের সমর্থন নির্ভর করছে এই প্রত্যাশার ওপর যে, উত্তর কোরিয়া খুব বেশি আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে না। আর চীনের এই প্রত্যাশা সবসময় পূরণ হয়নি।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাস্টিন হেস্টিংস বলেন, কিমের স্থায়ী নীতি হলো অন্য উৎস থেকে সমর্থন ও নিরাপত্তা খোঁজা। যাতে চীনের প্রভাব সর্বনিম্ন হয় এবং উত্তর কোরিয়ার স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ হয় সর্বাধিক।
গত বছর রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির আওতায় উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা ইউক্রেন যুদ্ধে লড়াই করছেন। হেস্টিংস বলেন, কুচকাওয়াজে কিমকে আমন্ত্রণ জানানো প্রমাণ করে শি জিনপিং চান উত্তর কোরিয়াকে বেইজিংয়ের কক্ষপথে রাখতে; যখন মস্কোর সঙ্গে পিয়ংইয়ংয়ের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে।
সূত্র: এএফপি।
এসএস