পঁচাত্তরে মোদি, এবার বিজেপিতে অবসরের বয়স নিয়ে বিতর্ক থামবে?

নেতাদের কী ৭৫ বছর বয়সের পর সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসা উচিত? গত এক দশক ধরে ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি) ঘুরেফিরে এই প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিবারই যখন কোনো বিজেপির প্রবীণ নেতা ওই বয়সে পৌঁছান, তখনই তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও বয়সও এখন ৭৫ বছর এবং সেই একই বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে বিবিসি হিন্দি এমন কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা বিজেপিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ৭৫ বছর বয়সের পর সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল ২০১৪ সালে, ভারতের সাধারণ নির্বাচনের সময়।
বিবিসি হিন্দির সঙ্গে কথোপকথনের সময় প্রবীণ সাংবাদিক ও দ্য প্রিন্টের রাজনৈতিক সম্পাদক ডি কে সিং বলেছেন, নরেন্দ্র মোদিকে যখন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হচ্ছিল, সেই সময় দলের অনেক বড় নেতা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না।
লাল কৃষ্ণ আদভানী ও মুরলী মনোহর যোশীর মতো নেতারা মোদির বিরুদ্ধে ছিলেন। মোদি জানতেন, সরকারে তাদের স্থান দেওয়া হলে তার স্বাধীনতায় প্রভাব পড়বে। তখনই একটা যুক্তি খাড়া করা হয়েছিল যে, ৭৫ বছর বয়সের পরে নেতারা সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসবেন।
তবে তিনি বলেন, বিজেপি কখনো এই নিয়ম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেনি। এই পার্টি কনস্টিটিউশনেও একথা নথিভুক্ত করা হয়নি। ডি কে সিং বলেছেন, সেই সময় বিজেপি নেতা ও মুখপাত্ররা সাংবাদিকদের অব দ্য রেকর্ড (অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করা) এই কথাগুলো বলতেন। এর একটা ন্যারেটিভও তৈরি করা হয়েছিল। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো কিছু বলা হয়নি।
এরপর ২০১৪ সালেই আদভানী, জোশী এবং অন্যান্য প্রবীণ নেতাদের মার্গদর্শন মণ্ডলের (যারা পথপ্রদর্শন করবেন) অংশ করা হয়েছিল। তবে যতদূর জানা যায়, এপর্যন্ত তাদের একটাও বৈঠক হয়নি। সিং বলেছেন, এই নিয়ম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম মেনেছিলেন আনন্দীবেন প্যাটেল। তিনি ২০১৬ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন।
সে সময় তিনি বলেছিলেন, নভেম্বরে আমার বয়স ৭৫ বছর হতে চলেছে। আনন্দীবেন বলেছিলেন, আমি বরাবরই বিজেপির আদর্শ, নীতি ও শৃঙ্খলা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। আজ পর্যন্ত আমি সেটাই অনুসরণ করে আসছি। বেশ কিছুদিন ধরে দলের ৭৫ বছরের বেশি বয়সের নেতা এবং কর্মীরা স্বেচ্ছায় তাদের পদ ছেড়ে দিচ্ছেন, যাতে তরুণরা সুযোগ পায়। এই পরম্পরা অত্যন্ত ভালো। নভেম্বর মাসে আমিও ৭৫ বছর পূর্ণ করতে চলেছি।
তার বক্তব্য সে সময় এই বার্তা দিয়েছিল যে দলে একটা বয়সসীমা রয়েছে। তবে এরপরে যে এই নিয়ম সব সময় মেনে চলা হয়েছে, তা নয়।
• নিছক সঙ্কেত নাকি কড়া নিয়ম?
সাংবাদিক অদিতি ফড়নবীশ দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির রাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) কাজকর্ম কাভার করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ৭৫ বছর বয়সে অবসর নেওয়া নিছকই সঙ্কেত। তার কথায়, বিজেপিতে বরাবরই বিশ্বাস রয়েছে যে সময়ে সময়ে যুবসম্প্রদায়ের হাতে নেতৃত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু কখন এই নিয়ম প্রয়োগ করা হবে এবং কখন হবে না, তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর।
২০১৪ সালে আদভানী ও জোশীকে সরিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। কারণ দলটি একটা নতুন মুখ আনতে চেয়েছিল। একইভাবে, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সুনীল গাতাড়ে বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন, বিজেপিতে ৭৫ বছর বয়সের পর সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসা সংক্রান্ত নিয়ম আসলে সফট গাইডলাইন ছিল; কোনো কঠোর বিধান নয়।
তার কথায়, দল আসলে এর ব্যবহার করেছিল প্রবীণ নেতাদের সম্মানজনক উপায়ে সাইডলাইন করার উদ্দেশ্যে। যখনই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা হয়েছে, তখনই এর ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছে। তাই আজ প্রশ্ন উঠছে যে এই নিয়ম কি শুধুমাত্র আদভানী-যোশীর মতো নেতাদের জন্য, না কি সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত?
• বয়স নিয়ে বিতর্ক
নাজমা হেপতুল্লা ও কলরাজ মিশ্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ছিলেন। এরপর তারা গভর্নরের পদে আসীন হন। এরপরই আলোচনা হয় যে বয়সের কারণেই এমনটা হয়েছে। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করার সময় বিএস ইয়েদুরাপ্পার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
বিজেপির প্রবীণ নেতা যশবন্ত সিন্হাকেও লাল কৃষ্ণ আডবাণী এবং মুরলী মনোহর যোশীর মতো সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি তখন বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরে ৭৫ বছরের বেশি বয়সের নেতাদের ব্রেন ডেড বলে ঘোষণা করেছেন।
অন্যদিকে, বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত কয়েকদিন আগে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, দলীয় গঠনতন্ত্রে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৭৫ বছর বয়সে অবসর নেবেন না।
শাহ বলেছিলেন, ভারতীয় জনতা পার্টির কনস্টিটিউশনে কোথাও এটা লেখা নেই। মোদীজি এই মেয়াদ শেষ করবেন এবং দেশকে নেতৃত্ব দেবেন। এ নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টিতে কোনও বিভ্রান্তি নেই। এই বিভ্রান্তি শুধু তৈরি করা হচ্ছে।
• মোহন ভগবতের মন্তব্য নিয়ে আলোচনা
চলতি বছরের বছরের জুলাই মাসে আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতের একটা বিবৃতির পর এই নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হয়। তিনি প্রবীণ আরএসএস নেতা মোরোপন্ত পিঙ্গালের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছিলেন।
মোহন ভগবত জানিয়েছেন, যখন মোরোপন্ত পিঙ্গলকে একটা অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তাকে একটা শাল দিয়ে সম্মানিত করা হয়। তখন তিনি বলেছিলেন, ৭৫ বছর বয়সে আমাকে একটা শাল দিয়েছেন। আমি জানি এর কী অর্থ হতে পারে।
‘‘যখন ৭৫ বছর বয়সে কাউকে সম্মানিত করা হয়, তখন তার অর্থ হলো, আপনার সময় শেষ। এখন আপনি পিছিয়ে যান এবং আমাদের কাজ করতে দিন।’’
এই প্রসঙ্গে অদিতি ফড়নবীশ বলেন, মোহন ভগবতের এই মন্তব্যের আগে, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়, বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা বলেছিলেন, তার দল আরএসএস ছাড়াও নির্বাচনে লড়াই করতে পারে। ফড়নবীশের কথায়, সেই সময় বিজেপির কোনও প্রবীণ নেতাকেই কিন্তু নাড্ডার বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি। ভগবতের বক্তব্যকে আমাদের সেই প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে।
ভগবতের বক্তব্যের পর এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, তিনি কি প্রধানমন্ত্রী মোদির বিষয়ে কথা বলছিলেন। কারণ চলতি বছরেই প্রধানমন্ত্রী মোদির ৭৫ বছর হচ্ছে। মোহন ভগবত অবশ্য তার মন্তব্যের প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদি বা বিজেপির কোনো অনানুষ্ঠানিক নিয়মের কথা বলছেন না। প্রসঙ্গত, মোহন ভগবতেরও এই বছরই ৭৫ বছর পূর্ণ হয়েছে।
• বিজেপির ভাবনা কী?
বিজেপির মুখপাত্ররা এই বিষয় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন নেতা তাদের মতামত জানিয়েছেন। একজন সাবেক বিজেপি সাংসদ বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন, সাম্প্রতিক নির্বাচনে ৭৫ বছরের বেশি বয়সের অনেক লোককে টিকিট দেওয়া হয়েছে কারণ তারা দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
‘‘আবার বহু এমন সদস্যও রয়েছেন যাদের টিকিট দেওয়া হয়নি কারণ তাদের বয়স ৭৫ বছরের বেশি। যেহেতু কোনও এই নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো নিয়ম নেই, তাই তা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্যও নয়।’’
অন্যদিকে এক যুব নেতার মতে, অবসরের একটা বয়স হওয়া উচিত। তবেই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, কারণ এটা তরুণরা সুযোগ করে দেবে।
প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিষয়টা আলাদা। কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যারা হাঁটতে পারেন না, তবুও রাজ্যসভায় যেতে চান। কেন তারা তরুণদের পথ দেখাতে পারছেন না আর কেনই বা দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারছেন না? কেন তাদের সরকারি বা সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত থাকা দরকার?
• বিতর্ক থামবে?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বয়সের এই ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে বিজেপির মধ্যে কখনোই কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। অদিতি ফড়নবীশ বলেছেন, এই প্রশ্ন কখনো ছিল না এবং ভবিষ্যতেও উঠবে না। এটা একটা ভুয়া বিতর্ক। বিজেপিতে এমন অনেক পদাধিকারী রয়েছেন; যাদের বয়স ৭৫ বছর হতে চলেছে। এই অব্যক্ত নিয়মের প্রয়োগ কিন্তু সবসময়েই খুব সিলেক্টিভভাবে (বাছাই করে বোঝাতে) হয়ে এসেছে।
সুনীল গাতাড়েও একই মতামত পোষণ করেন। তিনি বলেন, এই ডিবেট কোথা থেকে এসেছে? বিজেপিতে কখনও এমন কোনো ডিবেট দেখা যায়নি। শীর্ষ নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং দলকে তা মেনে চলতে হয়েছে। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এই নিয়ম কখনোই প্রযোজ্য নয়।
ডি কে সিং স্বীকার করেছেন, এই নিয়ম আনুষ্ঠানিক নয়। তবে বিজেপি ও আরএসএস ঐতিহাসিকভাবে তরুণ নেতাদের সুযোগ দিয়েছে। তার কথায়, বিজেপিতে এটা একটা সংস্কৃতি। অটল বিহারী বাজপেয়ীও অরুণ সংঘেরই সংস্কৃতি। বিবিসি বাংলা।
এসএস