হয়তো জানতেও পারবো না, মা কবে মারা গেছেন: সু চির ছেলে কিম

মিয়ানমারের কারাবন্দী গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির শারীরিক অবস্থার অবনতি এবং তাকে নিয়ে তথ্য না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন তার ছেলে কিম আরিস। মিয়ানমারের এই নেত্রীর বন্দিদশা ও শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে আশঙ্কা করে কিম আরিস বলেছেন, তিনি হয়তো জানতেই পারবেন না, তার মা কবে মারা গেছেন।
সোমবার ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে অং সান সু চিকে নিয়ে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার ছেলে কিম আরিস। রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, ৮০ বছর বয়সী মায়ের সঙ্গে তিনি বছরের পর বছর ধরে যোগাযোগ করতে পারছেন না। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে সু চি নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে তার হৃদ্যন্ত্র, হাড় ও মাড়ির সমস্যার বিষয়ে কেবল বিচ্ছিন্ন এবং পরোক্ষ কিছু তথ্যই তিনি পেয়েছেন।
চলতি মাসের শেষের দিকের নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে মিয়ানমারের জান্তার প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন কিম আরিস। তবে নির্বাচনী এই প্রক্রিয়া তার মায়ের দুর্দশা লাঘবের একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে বলে আশাপ্রকাশ করেছেন তিনি। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা মিয়ানমারের সামরিক জান্তার এই নির্বাচনকে ধোঁকাবাজি বলে মনে করে।
জাপানের রাজধানী টোকিওতে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিম আরিস বলেন, ‘‘তার মায়ের বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা রয়েছে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তাকে কেউ দেখেনি। তার আইনজীবীদের সঙ্গেও যোগাযোগের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পরিবার তো দূর। আমার জানা মতে, তিনি ইতোমধ্যে মারা গেছেন—এমনও হতে পারে।’’
তিনি বলেন, আমার মাকে নিয়ে (মিয়ানমারের জান্তা নেতা) মিন অং হ্লেইংয়ের নিজস্ব এজেন্ডা আছে বলে মনে করি। নির্বাচনেরআগে কিংবা পরে সাধারণ জনগণকে শান্ত করার জন্য তাকে মুক্তি দিয়ে অথবা গৃহবন্দী করে যদি তাকে ব্যবহার করতে চান; তাহলেও অন্তত কিছু একটা হতো।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে টেলিফোন করা হলেও মিয়ানমারের জান্তার এক মুখপাত্র সাড়া দেননি বলে জানিয়েছে রয়টার্স। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ইতিহাসে সরকারি ছুটির দিন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার নজির রয়েছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সু চি ২০১০ সালের নির্বাচনের কয়েক দিন পর মুক্তি পেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে ইয়াঙ্গুনের ইনয়া হ্রদের ধারে ঔপনিবেশিক আমলের পারিবারিক বাড়িতে দীর্ঘ সময় ধরে চলা তার গৃহবন্দিত্বের অবসান ঘটে।
২০১৫ সালের নির্বাচনের পর তিনি মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো নেতা হন। দেশটির ওই নির্বাচনকে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বলে মনে করা হয়। তবে পরবর্তীতে দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ ওঠায়, তার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
• সুযোগের সম্ভাবনা
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা চলছে। সামরিক ওই অভ্যুত্থান মিয়ানমারে সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা করেছে; যা দেশটির বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে।
নির্বাচনে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে সু চিকে ২৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত মিয়ানমারের আদালত। যদিও মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী এই নেত্রী তার বিরুদ্ধে আনা সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
আরিস বলেন, তার বিশ্বাস সু চিকে রাজধানী নেপিদোতে আটক রাখা হয়েছে। দুই বছর আগে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সর্বশেষ চিঠিতে তিনি গ্রীষ্ম ও শীত—দুই মৌসুমেই কারাকক্ষে ব্যাপক তাপমাত্রা নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন।
বিশ্বজুড়ে নানা সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় মিয়ানমারের বিষয়টি মানুষ ভুলে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন আরিস। তিনি আসন্ন নির্বাচনকে কাজে লাগাতে চান; যা অভ্যুত্থানের পর প্রথম নির্বাচন এবং ধাপে ধাপে ২৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। জাপানের মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি জান্তার বিরুদ্ধে আরও চাপ সৃষ্টি ও তার মায়ের মুক্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
কিম আরিস বলেন, সামরিক বাহিনী যে নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে, আমরা সবাই জানি তা একেবারে সাজানো। অবাধ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না—এমন অবস্থা যে হাস্যকর না হলেও দুঃখজনকই বলা যায়। এই কারণেই আমাকে সুযোগের এই ক্ষুদ্র জানালাটি ব্যবহার করতে হবে।
তিনি বলেন, আগে যখন আন্তর্জাতিক মহলে আমার মায়ের মর্যাদা বেশি ছিল, তখন বার্মায় কী ঘটছে তা উপেক্ষা করা মানুষের জন্য অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু রাখাইনে সৃষ্ট সংকটের কারণে তার অবস্থান দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এখন আর তা নেই।
ব্রিটিশ নাগরিক আরিস কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আড়ালে ছিলেন। তিনি বলেন, ২০১৬-১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর চালানো অভিযানে তার মা জড়িত ছিলেন না। রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংস অভিযানকে জাতিসংঘ গণহত্যা বলে অভিহিত করেছে।
ডি-ফ্যাক্টো নেতা থাকাকালীন মিয়ানমারের সংবিধানে দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর সু চির ক্ষমতা সীমিত ছিল। ২০২০ সালে হেগে আন্তর্জাতিক এক ট্রাইব্যুনালে তিনি স্বীকার করেন, যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে। তবে গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
জাপান সফরের সময় রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কিম আরিস বলেন, জান্তার বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ ও নির্বাচন প্রত্যাখ্যানে জাপানের বিভিন্ন রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন।
মা অং সান সু চি তার এই প্রচেষ্টা সম্পর্কে কী ভাবতেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, তিনি ভীষণ দুঃখ পেতেন যে আমাকে এটা করতে হচ্ছে। তিনি সব সময়ই চেয়েছেন, আমাকে যেন এতে জড়াতে না হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার আসলে কোনও বিকল্প নেই। শেষ পর্যন্ত আমি তার ছেলে। আর আমি যদি এটা না করি, তাহলে অন্য কারও কাছ থেকেও তা আশা করতে পারি না।’’
সূত্র: রয়টার্স।
এসএস