ট্রাম্পকে ছেড়ে বাইডেনের পেছনে শীর্ষ মার্কিন জেনারেলরা

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের প্রতীক ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা; বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা এই হামলার আগের ও পরের পরিস্থিতি যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ট্রাম্পের জন্য তো এটা আরও বেশি প্রযোজ্য।
টানা দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রমাণ ছাড়া নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ করে আসা ট্রাম্প অবশেষে নীরব হয়েছেন, মেনে নিয়েছেন নির্বাচনে নিজের পরাজয়। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরেরও। তারপরও যেন ট্রাম্প একা। কেউ নেই তার পাশে।
গত ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর শীর্ষ জেনারেলসহ প্রতিটি শাখার কর্মকর্তারা।
একইসঙ্গে নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে ট্রাম্পের দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে স্বাগতও জানিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) এক যৌথ স্মারকলিপিতে এসব বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেল ও কর্মকর্তারা। জেনারেল মার্ক মিলির নেতৃত্বে জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের আট সদস্যের সকলে এতে স্বাক্ষর করেন।
স্মারকলিপিতে ক্যাপিটলে হামলার ঘটনার নিন্দা করে দেশটির সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ওই ঘটনা কেবল অন্যায় নয়, আইন ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার ওপর আক্রমণ। ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হওয়া উচিত।’
ক্যাপিটল ভবনে হামলার পর ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রিস মিলারসহ ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য নিন্দা জানালেও মার্কিন সামরিক বাহিনীর শীর্ষ জেনারেল ও জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান মার্ক মিলি এতোদিন চুপ ছিলেন। অবশেষে অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে মঙ্গলবার তিনিও মুখ খুললেন।
এদিকে নির্বাচনে কারচুপি ও নিজে জয়ী হয়েছেন বলে ট্রাম্পের একতরফা দাবির বিষয়েও স্মারকলিপিতে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন সেনা কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন,‘ট্রাম্প যা-ই দাবি করুক না কেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন জো বাইডেন।’
ওই স্মারকলিপিতে বলা হয়, সংবিধান রক্ষা করা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব। একইসঙ্গে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনকে স্বাগতও জানিয়েছেন তারা।
অবশ্য কট্টর জাতীয়তাবাদী ট্রাম্পের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক খারাপ ছিল, এমন কথা কখনও শোনা যায়নি। বরং আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহার, ইউরোপ থেকে সেনা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ইতোপূর্বে স্বাগত জানিয়েছিল মার্কিন সেনাবাহিনী। এবার সেই সেনাই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কেবল মুখই খুলল না, রীতিমতো প্রকাশ্যে স্মারকলিপি এনে তাকে বিড়ম্বনায় ফেলল।
গত ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে হামলা চালায় ট্রাম্প সমর্থকরা। কংগ্রেসের যৌথ ওই অধিবেশনে সেদিন জো বাইডেনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তুতি চলছিল।
একপর্যায়ে ক্যাপিটল ভবনের নিরাপত্তা ব্যারিকেড ও মূল ফটক ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়েন ট্রাম্প সমর্থকরা। হামলাকারীদের অনেকেই ছিল সশস্ত্র। ভেতরে ঢুকে সিনেট হলে রীতিমতো তাণ্ডব চালায় তারা।

শুধু তা-ই নয়, স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতার কার্যালয়ও তছনছ করে তারা। হামলা-সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্যসহ নিহত হন পাঁচজন। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ৬ জানুয়ারি একটি কলঙ্কিত দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পর্যায় থেকে ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এমনকি ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানরাও হামলার ঘটনার নিন্দা করেন। সাবেক প্রেসিডেন্টরা দলমত নির্বিশেষে ঘটনার নিন্দা করেন। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো সেনাবাহিনী।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রতিটি শাখার চিফ অফ স্টাফ ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিবাদ করার অধিকার সকলের আছে। কিন্তু প্রতিবাদের নামে সহিংসতার অধিকার কারও নেই। এ কথা প্রত্যেক নাগরিককে মনে রাখতে হবে। যারা ক্যাপিটলে হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হওয়া উচিত।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে বলছে, ক্যাপিটলের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে মার্কিন বিমান বাহিনীর এক সাবেক নারী কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন। বিমান বাহিনীর সাবেক ওই কর্মকর্তা ছিলেন ট্রাম্পের সমর্থক। কংগ্রেসের সিনেট হলে ঢুকে তাণ্ডব চালাচ্ছিলেন তিনি। বাধ্য হয়েই পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।

সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে অবশ্য সেই ঘটনার কোনো উল্লেখ নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা, ক্যাপিটল ভবনে হামলার ঘটনায় সরাসরি সেনাবাহিনীর নাম চলে আসাতেই দ্রুত বিবৃতি দিয়ে ঘটনার নিন্দা করলেন মার্কিন সামরিক বাহিনীর তিনটি শাখার সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা।
এদিকে ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বার অভিশংসিত (ইমপিচ) করতে প্রস্তাব পেশ করেছেন প্রতিনিধি পরিষদের আইনপ্রণেতারা। ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের কাছে দাবিও জানিয়েছেন তারা। মার্কিন সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী অনুসারে এ কাজ করতে পারেন পেন্স।

তবে মঙ্গলবার রাতেই স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এ কাজ তিনি করবেন না।
ডেমোক্র্যাটরা তো বটেই রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারদেরও একটি অংশ আগামী ২০ জানুয়ারির আগেই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ট্রাম্পকে অপসরণ করতে চাচ্ছে।
সূত্র: রয়টার্স ও ডি ডব্লিউ।
টিএম