মহামারি অবসানের বৈশ্বিক লড়াই, টিকা পেলেন কত কোটি মানুষ?

ইতিহাসের সর্ববৃহৎ টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। বিশ্বের ৪৩টি দেশে এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ৫৬ লাখের বেশি মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া হয়েছে। মহামারি থেকে সুরক্ষায় কোটি কোটি মানুষের কাছে এই ভ্যাকসিন পৌঁছে দেয়াই আধুনিক বিশ্বের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট ফাইজার এবং জার্মানির বায়োটেক কোম্পানি বায়োএনটেকের তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্তত ৪৩টি দেশে অনুমোদন পেয়েছে। ফাইজার-বায়োএনটেকের এবং মডার্নার দু’টি টিকাই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ৯৫ শতাংশ হ্রাস করতে সক্ষম; যা হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবীর দেহে চালানো পরীক্ষায় দেখা গেছে।
ব্রিটিশ-সুইডিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনটি যুক্তরাজ্যে অনুমোদন পেয়েছে গত ৩০ ডিসেম্বর। সাধারণের ব্যবহারের জন্য সিনোফার্মের একটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে চীন। আগামী মাসের শুরুর দিকেই ৫ কোটি চীনা নাগরিককে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে দেশটি।

বিশ্বের অন্যান্য দেশও করোনাভাইরাসের টিকার প্রয়োগ শুরু করতে যাচ্ছে। তৃতীয় তথা শেষ ধাপের পরীক্ষা শেষের আগেই গত জুলাই এবং আগস্টে নিজেদের তৈরি করোনার টিকার অনুমোদন দেয় চীন এবং রাশিয়া। তখন থেকে লাখ লাখ মানুষের শরীরে করোনার টিকা প্রয়োগ করে এ দুই দেশ। যদিও তাদের ভ্যাকসিনের পরীক্ষার ফলের ব্যাপারে খুব কমই তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস টিকাদান কর্মসূচি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে অনেক দেশ ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হারেও ভিন্নতা রয়েছে।
ইসরায়েলের টিকাদানের হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় ওই বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। দেশটিতে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ২০ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ করোনার টিকা পেলেও বিশ্বের অনেক দেশ এখনও টিকার প্রাপ্তিই নিশ্চিত করতে পারেনি।
মহামারি অবসানের লড়াই
বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ৯টি করোনা ভ্যাকসিনের অগ্রগতির বিষয়ে খোঁজ রাখছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ। এখন পর্যন্ত সাতটি ভ্যাকসিন জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য সহজলভ্য হলেও উৎপাদনের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় খুবই নগন্য। মাত্র কয়েক ডজন দেশে এসব ভ্যাকসিনের প্রয়োগ চলমান রয়েছে।
করোনাভাইরাসের নতুন নতুন ভ্যাকসিন প্রযুক্তি তৈরি, হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবীর দেহে সেসবের পরীক্ষা, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে রেকর্ড দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিন বাজারে আনার জন্য শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ চলছে বিশ্বজুড়েই।
বিশ্বের ৭৮০ কোটির বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার জন্য এসব ভ্যাকসিনের কোনোটিই পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু সব ভ্যাকসিন একত্রে বিশ্বজুড়ে ১৯ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া করোনাভাইরাস মহামারির অবসানের সর্বোত্তম সুযোগ তৈরি করতে পারে।
ভ্যাকসিন চুক্তি
শতাব্দির ভয়াবহতম মহামারি থেকে মুক্তির চেষ্টায় মরিয়া অনেক দেশ করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পেতে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করেছে। ব্লুমবার্গের করোনা ট্র্যাকার বলছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে প্রায় সাড়ে ৮০০ কোটি ভ্যাকসিন ডোজের চুক্তি হয়েছে।
যদি সমতার ভিত্তিতে বণ্টন করা হয় তাহলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে; কারণ অধিকাংশ ভ্যাকসিনের দু’টি করে ডোজ নিতে হয়। যদিও এখন পর্যন্ত তেমনটা ঘটেনি। বিশ্বের ধনী দেশগুলো ব্যয়বহুল সরবরাহ চুক্তি সম্পন্ন করেছে।
এছাড়া অতি-শীতল সংরক্ষণ ব্যবস্থার দরকার হওয়ায় কিছু ভ্যাকসিন বিশ্বের অনেক স্থানে পৌঁছানো জটিল হতে পারে। কিছু দেশকে এই ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য ২০২২ সাল এমনকি তারও বেশি সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে।
তবে ভ্যাকসিন সরবরাহের দৌড়ে অন্যান্যদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা।
ইতোমধ্যে ব্রিটিশ এই কোম্পানি যেসব চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তাতে ১৪৮ কোটি মানুষ তাদের ভ্যাকসিন পাবেন; যা অন্যান্য কোম্পানির ভ্যাকসিনের চুক্তির তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এখন পর্যন্ত মোটাদাগে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ৯০টির বেশি চুক্তি শনাক্ত করেছে ব্লুমবার্গ।
তবে প্রত্যেকটি ভ্যাকসিন যে কাজ করবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। গত ১০ ডিসেম্বর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আশানুরূপ ফল না মেলায় অস্ট্রেলিয়ার তৈরি নিজস্ব একটি ভ্যাকসিনের মজুদ রাখা ৫ কোটি ১০ লাখ ডোজকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। ভ্যাকসিন প্রাপ্তির কৌশলও একেক দেশের একেক রকম। যুক্তরাষ্ট্র ভ্যাকসিনের সরবরাহের জন্য একতরফা বেশ কয়েকটি চুক্তি করেছে।

সমতার ভিত্তিতে বণ্টন নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নিজস্ব উদ্যোগ কোভ্যাক্সের মাধ্যমে কয়েক ডজন দেশ ভ্যাকসিন পাবে। অন্যদিকে, লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশে সস্তায় ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে মেক্সিকান বিলিওনেয়ার কার্লোস স্লিম একটি উদ্যোগ নিয়েছেন।
তবে চুক্তির বাইরে কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগও রয়েছে।
ভারত ২২০ কোটি ভ্যাকসিন ডোজ উৎপাদনের চুক্তি করেছে; যেগুলো দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশিদের মাঝে সরবরাহের পরিকল্পনা করেছে দেশটি।
কোন দেশে কত মানুষ পেলেন টিকা?
|
দেশ |
টিকা প্রয়োগের সংখ্যা |
শতাংশ |
তারিখ |
|
বিশ্বজুড়ে |
৩ কোটি ৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৮ |
- |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
যুক্তরাষ্ট্র |
৯৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৫ |
৩.০৩ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
চীন |
৯ লাখ |
০.৬৪ |
৮ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
ইউরোপ |
৩২ লাখ ১৩ হাজার ৭৪৫ |
০.৭২ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
যুক্তরাজ্য |
২৮ লাখ ৪৩ হাজার ৮১৫ |
৪.২৬ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
ইসরায়েল |
১৮ লাখ ৭১ হাজার ২৮৮ |
২০.৬৭ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
রাশিয়া |
১৫ লাখ |
১.০২ |
১১ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
সংযুক্ত আরব আমিরাত |
১২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৫২ |
১১.৮৭ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
ইতালি |
৭ লাখ ৫২ হাজার ৬০৮ |
১.২৫ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
জার্মানি |
৬ লাখ ৮৮ হাজার ৭৮২ |
০.৮৩ |
১১ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
স্পেন |
৪ লাখ ৮৮ হাজার ১২২ |
১.০৫ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
কানাডা |
৩ লাখ ৭৪ হাজার ৩৬৬ |
১.০০ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
পোল্যান্ড |
২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৩৪ |
০.৬৮ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
ফ্রান্স |
১ লাখ ৮৯ হাজার ৮৩৪ |
০.২৯ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
সৌদি আরব |
১ লাখ ৭৮ হাজার ৩৩৭ |
০.৫২ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
রোমানিয়া |
১ লাখ ৪০ হাজার ৪৪৭ |
০.৭২ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
ডেনমার্ক |
১ লাখ ১৭ হাজার ১০৪ |
২.০২ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
আর্জেন্টিনা |
১ লাখ ৭ হাজার ৫৪২ |
০.২৪ |
৮ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
বাহরাইন |
৯২ হাজার ৫৯৮ |
৬.২৪ |
১১ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
মেক্সিকো |
৮৭ হাজার ৬০ |
০.০৭ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
সুইডেন |
৮০ হাজার |
০.৭৭ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
হাঙ্গেরি |
৭৮ হাজার ৫৭৯ |
০.৮০ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
পর্তুগাল |
৭৪ হাজার ৯৯ |
০.৭২ |
১১ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
গ্রিস |
৫৫ হাজার ৯৮৮ |
০.৫২ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
চেক রিপাবলিক |
৪০ হাজার |
০.৩৮ |
১১ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
অস্ট্রিয়া |
৩৮ হাজার ৫৪৫ |
০.৪৪ |
১১ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
নেদারল্যান্ডস |
৩৮ হাজার |
০.২২ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
স্লোভাকিয়া |
৩১ হাজার ৭৮৫ |
০.৫৮ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
ক্রোয়েশিয়া |
২৭ হাজার |
০.৬৬ |
১১ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
লিথুনিয়া |
২৪ হাজার ৯৯৬ |
০.৯০ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
স্লোভেনিয়া |
২২ হাজার ৪৮৪ |
১.০৯ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
নরওয়ে |
২১ হাজার ২১১ |
০.৪০ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
ওমান |
১৮ হাজার ২৮৭ |
০.৪৪ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
ফিনল্যান্ড |
১৭ হাজার ৬১৭ |
০.৩২ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
আয়ারল্যান্ড |
১৫ হাজার ৩১৪ |
০.৩১ |
০৭ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
বুলগেরিয়া |
১৪ হাজার ১৬১ |
০.২০ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
এস্তোনিয়া |
১০ হাজার ৯৭২ |
০.৮৩ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
চিলি |
১০ হাজার ৬৯৯ |
০.০৬ |
০৯ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
কোস্টারিকা |
৯ হাজার ৭৫১ |
০.১৯ |
০৮ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
সার্বিয়া |
৯ হাজার ৩০০ |
০.১৩ |
১০ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
লাটভিয়া |
৮ হাজার ২৭৪ |
০.৪৩ |
১২ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
আইসল্যান্ড |
৪ হাজার ৯১৭ |
১.৩৮ |
০৫ জানুয়ারি পর্যন্ত |
|
কুয়েত |
২ হাজার ৫০০ |
০.০৫ |
২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত |
|
লুক্সেমবার্গ |
১ হাজার ২০০ |
০.২০ |
৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত |
|
গিনি |
৫৫ |
০.০০ |
৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত |
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের উৎপত্তি হওয়ার পর বিশ্বের ২১৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে। এতে বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ কোটি ২১ লাখের বেশি মানুষ এবং মৃত্যু ছাড়িয়েছে ১৯ লাখ ৭২ হাজার।
করোনার উত্থান এবং বৈশ্বিক মহামারি
• ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়
• চীনে করোনায় প্রথম প্রাণহানি ঘটে ৯ জানুয়ারি
• ১৩ জানুয়ারি চীনের বাইরে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় থাইল্যান্ডে
• এই ভাইরাসে বিশ্বে প্রথম প্রাণহানি ঘটে ২ জানুয়ারি ফিলিপাইনে
• ১১ মার্চ ‘করোনা মহামারি’ ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সূত্র: ব্লুমবার্গ, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, ওয়ার্ল্ডোমিটারস।
এসএস