জলবায়ু পরিবর্তনে চূড়ান্ত বিপদের সামনে বিশ্ব

প্রায় ৩০০ বছর আগে শিল্পভিত্তিক সভ্যতায় প্রবেশ করেছে মানবজাতি। দিন যত যাচ্ছে, পুরো উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া ও মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠছে কলকারখানা ও শিল্প-প্রযুক্তি নির্ভর।
কিন্তু এই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে শিল্প-কলকারখানা ও যানবাহনে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে মানবজাতির সামনে, যার উপসর্গ বা লক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন নিরীক্ষণ বিষয়ক জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রসমূহের সংস্থা আইপিসিসির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এই তথ্য এসেছে।
শিল্পভিত্তিক এই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখা ও শক্তি উৎপাদনে গত প্রায় তিনশ বছর ধরে কয়লা ও পেট্রোলিয়ামের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমন্ডলে প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন ও অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাসের উপস্থিতি।
আইপিসিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর ফলে গত তিনশ বছরে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং পরবর্তী ২০ বছরে এই তাপমাত্রা উন্নীত হবে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের দেশে দেশে দেখা দেখা দিচ্ছে তাপদাহ ও খরা। পাশাপাশি, অতি বৃষ্টির প্রভাবে বন্যাও দেখা দিচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এই মুহূর্ত থেকে যদি জরুরিভিত্তিতে বিশ্বজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলেও বাড়তে থাকবে বিশ্বের তাপমাত্রা এবং আগামী ৬০ বছর পর গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তারপর তা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে।
আর বর্তমানে যে হারে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৬০ সালের মধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বাড়বে ২ ডিগ্রি সেলিসিয়াস এবং এই শতাব্দির শেষ নাগাদ তা বেড়ে পৌঁছাবে ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
গড় তাপমাত্রা বাড়ার ফলে কী ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে- রয়টার্সের প্রশ্নের উত্তরে আইপিসিসির সাম্প্রতিক ১৪০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটির অন্যতম লেখক ও আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সোনিয়া সেনেভিরাত্নে বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্বের যে তাপমাত্রা, তা গত ৩০ লাখ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।’
‘আজ থেকে ৩০ লাখ বছর আগে প্লাইস্টোসিন আমলে যখন বিশ্বের তাপমাত্রা বেশি ছিল, তখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ছিল বর্তমানের চেয়ে ২৫ মিটার (৮২ ফুট) বেশি।’
‘যদি তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকে, সেক্ষেত্রে আগামী শতকের মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে যে পরিমাণ বরফ গলবে, তাতে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়বে অন্তত ২ থেকে ২ দশমিক ৫ মিটার।’
‘এছাড়া তাপদাহের মাত্রা বাড়বে এবং সেসবের তীব্রতা এমন হবে যে বাড়ি থেকে বাইরে বের হলেই মারা যাবে মানুষ।’
সোনিয়া সেনেভিরাত্নে বলেন, ‘আমরা ঘোর জলবায়ু সংকটে আছে এবং এ বিষয়ক যাবতীয় প্রমাণ আমাদের কাছে আছে।’
‘কিন্তু আমরা কেবল তথ্য ও পরামর্শই দিতে পারি, বাস্তব ক্ষেত্রে সেগুলো প্রয়োগের ক্ষমতা আমাদের নেই।’
বর্তমানে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাসের অস্তিত্ব রয়েছে, তা আগামী এক কয়েক দশকের মধ্যে পৃথিবীর জলবায়ুর ভারসাম্য এলোমেলো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট বলে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে আইপিসিসির প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক জোয়েরি রোজেল্জ, ‘আমরা ইতোমধ্যে আমাদের গ্রহে প্রচুর পরিবর্তন এনেছি। সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু পরিবর্তন এমন যে, সেসব থেকে বিশ্বকে মুক্ত করে স্বাভাবিক বা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে প্রায় ১ হাজার বছর লেগে যাবে।’
‘তবে এখনও সুযোগ আছে। যদিও অনেক দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু তারপরও আমরা যদি জরুরিভিত্তিতে গ্রিন হাউস নিঃসরণ বন্ধে উদ্যোগ নেই, তাহলে কয়েক দশক পর থেকে এর সুফল পেতে শুরু করবর আমরা।’
এদিকে, আইপিসির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনকে মানবজাতির জন্য সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা বা ‘কোড রেড’হিসেবে বর্ণনা করে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উচ্চমাত্রায় দূষণ ঘটানো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যত দ্রুত সম্ভব বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বিপদঘণ্টা বেজে গেছে। আইপিসিসির প্রতিবেদনকে আমাদের সবার আমলে নেওয়া উচিত এবং আমাদের গ্রহকে ধ্বংস করে ফেলার আগেই কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির মৃত্যুঘণ্টা বাজানো উচিত।”
সূত্র : রয়টার্স
এসএমডব্লিউ