উহান লকডাউনের বছরপূর্তি: চীন যেভাবে মহামারি সামাল দিল

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথম নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। প্রথমে বলা হয়েছিল, উহান শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত হুনান সি-ফুড মার্কেট থেকেই প্রথম করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটে।
দেশটির সরকারি তথ্য অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম যে ব্যক্তি মারা যান, তার ওই মার্কেটে নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
৬১ বছর বয়স্ক ওই ব্যক্তি যখন মারা যান, তখনও এই রোগের নাম নির্দিষ্ট করা হয়নি। চীনের সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘অপরিচিত ধরনের নিউমোনিয়ায়’ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিনি।
তবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাস গত বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নেয়। এর কয়েকদিন আগে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি উহান শহর প্রথম লকডাউন করা হয়।
ধারণা করা হয়, এই শহর থেকেই প্রথম করোনাভাইরাস মহামারির রূপ নেয়। সেই সময়ে বিশ্ববাসী এই কঠিন বিধিনিষেধ এবং সেটার কঠোর বাস্তবায়নে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।
জানুয়ারির শেষ দিক থেকে জুন পর্যন্ত উহানকে চীনের অন্য এলাকা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। যদিও এই সিদ্ধান্তের উচ্চ মূল্য দিতে হয়েছে, কিন্তু দিন শেষে লকডাউনকে ভাইরাস মোকাবিলা করার একটা সফল কৌশল হিসেবে দেখা হয়েছে।
এক বছর হতে চলেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে চীনকে এখন সফল বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ঠিক কীভাবে চীন লকডাউন থেকে আজ পর্যন্ত আসতে পারলো এবং বেইজিং কীভাবে তার নিজের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলো?
চীন কীভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকালো
২০১৯ সালের শেষের দিকে যখন প্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয় তখন দেশটির কর্তৃপক্ষ ‘রহস্যজনক অসুস্থতা’ বলে এর ব্যবস্থা একটু আস্তে ধীরেই নিয়েছিল। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ছিল চীনের নতুন বর্ষ পালন উৎসব উপলক্ষ্যে প্রচুর ভ্রমণ করে মানুষ। চীন সেটাতে কোনো বাধা দেয়নি।
চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা স্বাধীন প্যানেল তাদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে বলেছে, চীনা কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিতে ধীর গতিসম্পন্ন ছিল। তারা চীনের সেই সময়কার প্রতিক্রিয়াকে সমালোচনা করে বলেছে, ‘সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে পদক্ষেপগুলো জোরপূর্বক প্রয়োগ করতে পারতো।’

কিন্তু যখনই চীন বুঝতে পারে এটা একটা সমস্যা তখনই কর্তৃপক্ষ সেটা কঠোরভাবে দমন করার উদ্যোগ নেয়।
জানুয়ারির ২৩ তারিখ।
চীনের নতুন বছর উৎযাপনের দুই দিন আগে উহানের রাস্তা জনশূন্য হয়ে পড়ে। এক কোটি ১০ লাখ মানুষকে কঠোর কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। মুখের মাস্ক এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে দেশটি মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে বিশাল ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করে ফেলে।
তারপরেও উহানের বাসিন্দা উয়েজাং ওয়াং বলছিলেন তিনি কতটা ভীত ছিলেন। তিনি বলেছেন, সেই সময় তার চাচা কীভাবে মারা গিয়েছিল, তারা বাবা-মা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মেডিকেল সহায়তা পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব।
উহান যে কৌশলে ভাইরাস মোকাবেলা করছিল, সেভাবে চীনের অন্যান্য বড় শহর বেইজিং এবং সাংহাই তাৎক্ষণিক লকডাউন এবং ব্যাপক হারে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। ইতোমধ্যে চীন সেদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কঠিন নিয়ম এবং কোয়ারেন্টাইনে থাকার ব্যবস্থা করে।
কিন্তু প্রথম দিকে ভাইরাস সংক্রমণের খবরটা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারেও ছিল কঠোর চীনা কর্তৃপক্ষ। যেসব চিকিৎসক একে অপরকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন, তাদের তিরস্কার করা হয়েছিল এবং তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যেন তারা চুপ থাকেন।
এদের মধ্যে একজন ছিলেন ডা. লি ওয়েনলিয়াং। তিনি করোনাভাইরাস সংক্রমণে মারা যান। সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রাথমিক ভাবে কিছু প্রতিবেদন করতে পারছিল, কিন্তু উহান থেকে যেসব সাংবাদিক খবর পাঠাচ্ছিলেন, তাদের চুপ থাকতে বলা হয়। সম্প্রতি এদের একজনকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এসব পদক্ষেপ কী কাজে লেগেছিল?
যদিও চীনের এই কঠোর পদক্ষেপ মানুষের কাছে প্রথম দিকে কঠিন মনে হয়েছিল। কিন্তু এক বছর পর অফিসিয়াল তথ্যে দেখা যাচ্ছে, তাদের পদক্ষেপের ফলে তুলনামূলক কম মৃত্যু এবং শনাক্তের হার কম হয়েছে।
চীনে কোভিড ১৯-এ এ পর্যন্ত চার হাজার ৮০০ জন মারা গেছে এবং এক লাখ লোক সংক্রমিত হয়েছে। প্রাথমিক সংক্রমণের পর করোনায় আক্রান্তের সংখ্যাটা একেবারে কমে আসে এবং সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ দেখা যায়নি।
অবশ্য বিতর্ক থাকায় চীনের দেওয়া তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন।
উহানে জীবন এখন কেমন?
এক বছর পর উহানে জীবন অনেকটাই স্বাভাবিক। তারপরেও বিধিনিষেধ থাকার কারণে উহান এবং দেশের অন্যান্য অংশের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত ভাবেই গত বছর মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে।
উহানের বাসিন্দাদের সাথে সম্প্রতি কথা বলে মনে হয়- তাদের কেউ কেউ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে শঙ্কা বোধ করছে।
হ্যান মেইমেই নামে উহানের এক বাসিন্দা বলেন, ‘এই মহামারি নিশ্চিতভাবে পেছনে কিছু ফেলে যাচ্ছে, যেটা হয়তো ওপর থেকে নাও দেখা যেতে পারে।’
তারপরেও কিছু চাইনিজ নাগরিক মনে করেন- চীন এই মহামারি ভালোভাবে সামাল দিয়েছে।
লি সি নামে উহানের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘মহামারির আগে মানুষকে মনে হতো কিছুটা বদমেজাজী, সব সময় যেন তারা ছুটছে। কিন্তু মহামারির পর তারা জীবনের প্রতি আরও বেশি কৃতজ্ঞ এবং অনেক বেশি আন্তরিক হয়েছে।’
হ্যান মেইমেই বলেছেন, ‘এই ধরনের বিপর্যয় মানুষকে আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম