বিক্ষোভ: রাশিয়াজুড়ে আটক তিন হাজারেরও বেশি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমালোচক এবং দেশটির কারাবন্দি বিরোধী নেতা অ্যালেক্সেই নাভালনির মুক্তির দাবিতে রাজধানী মস্কোতে চলা বিক্ষোভ থেকে তার ৩ হাজারেরও বেশি সমর্থককে আটক করেছে পুলিশ।
শনিবার নাভালনির মুক্তির দাবিতে কয়েক লাখ সমর্থক মস্কো ও সেইন্ট পিটার্সবুর্গে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করলে তাদের ওপর চড়াও হয় রাশিয়ার পুলিশ। ব্যাপক লাঠিচার্জ করে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার সময় গ্রেফতার করা হয় অনেককে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কড়া সমালোচক ৪৪ বছর বয়সী আইনজীবী নাভালনিকে গত বছর আগস্টে রাসায়নিক বিষ দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। বিষক্রিয়ায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে গিয়েছিলেন নাভালনি।
জার্মানির একটি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন এবং গত রোববার দেশে ফেরেন। কিন্তু রাশিয়ায় ফেরার পর বিমানবন্দরেই গ্রেপ্তার হন নাভালনি।
অর্থ আত্মসাৎ মামলায় স্থগিত দণ্ডের প্যারোলের শর্ত লঙ্ঘনের দায়ে পরদিন সোমবার মস্কোর একটি আদালত তার ৩০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এরপরই সমর্থকদের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করার আহ্বান জানান নাভালনি।
লোকজনকে এই প্রতিবাদ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে বলেছিল, বিক্ষোভে অংশ নিলে কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে পাশাপাশি অননুমোদিত এসব আয়োজনে উপস্থিত হলে মামলা ও কারাবাসেরও সম্ভাবনা আছে।
রাশিয়ার মিছিল পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি সংগঠন ওভিডি ইনফো বিবিসিকে জানিয়েছে, বিক্ষোভে মস্কোসহ রাশিয়ার বিভিন্ন শহর থেকে এ পর্যন্ত ৩ হজার ১০০ জনকে আটক করেছে পুলিশ; এর মধ্যে শুধু মস্কো থেকেই আটক করা হয়েছে ১২০০’র অধিক বিক্ষোভকারীকে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ক্রেমলিন থেকে অবশ্য এ বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
‘আমরা ভয় পেতে পেতে ক্লান্ত’
গত রোববার নাভালনি সমর্থকদের বিক্ষোভ করার আহ্বান জানানোর পর থেকেই তার মুক্তির দাবিতে রাশিয়ার দূর পূর্বাঞ্চল এবং সাইবেরিয়ার প্রায় ১০০ টি শহর থেকে রাজধানী মস্কো এবং দেশটির দ্বিতীয় প্রধান শহর সেইন্ট পিটার্সবুর্গে জড়ো হতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা; এদের মধ্যে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীরা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছেন বয়স্ক লোকজনও।
রাশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদিও বলেছে, শনিবারের বিক্ষোভে রাজধানী মস্কোতে ৪০০০ প্রতিবাদকারী অংশ নিয়েছিলেন, তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে ওইদিন সেখানে অন্তত ৪০ হাজার বিক্ষোভকারী উপস্থিত ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সেদিনের বিক্ষোভে মস্কোতে যে পরিমাণ বিক্ষোভকারী জড়ো হয়েছিলেন- গত কয়েক দশকে রাশিয়ায় যত বিক্ষোভ হয়েছে, সেগুলোতেও এত মানুষ দেখা যায়নি।
মস্কোর পুশকিন স্কয়ারে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জড়ো হয়ে ‘নাভালনির মুক্তি চাই’, ‘পুতিন, তুমি বিদায় হও’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে থাকেন। সেখানে উপস্থিত এক নারী বিবিসিকে জানিয়েছেন, তিনি এই বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কারণ তার মনে হচ্ছে , পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া দিন দিন একটি কারাগারে পরিণত হচ্ছে।
বিক্ষোভে উপস্থিত ৫৩ বছর বয়সী সের্গেই রেডচেঙ্কো বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘আমি ভয় পেতে পেতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। শুধু নাভালানির মুক্তি বা নিজের জন্য আমি এখানে আসিনি, আমি এখানে এসেছি আমার ছেলের জন্য, কারণ এই দেশের কোনো ভবিষ্যত নেই।’
এর মধ্যে গত শনিবার থেকেই রাশিয়ায় মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে এর সঙ্গে বিক্ষোভের কোনো সম্পর্ক রয়েছে কী না তা নিশ্চিত করতে পারেনি বিবিসি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে বিক্ষোভ সম্পর্কিত অসংখ্য ভিডিও ব্যাপকভাবে পোস্ট ও শেয়ার করছেন প্রতিবাদকারীরা। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মিডিয়া পর্যবেক্ষক সংস্থা রোস্কোমনাদজোর ইতোমধ্যে টিকটককে হুঁশিয়ার করেছে, যদি বিক্ষোভকারীদের ধ্বংসাত্মক কাজে উস্কানিমূলক কোনো কন্টেন্ট প্রদর্শন করা হয়, সেক্ষেত্রে বড় ধরণের জরিমানা করা হবে টিকটককে।
দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অভিভাবকের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, তারা যেন তাদের সন্তানদের বিক্ষোভে অংশ নিতে না দেন।
এদিকে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডমিনিক রাব এক বিবিৃতিতে মস্কো, সেইন্ট পিটার্সবুর্গসহ একাধিক শহরে ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশি হামলার’ নিন্দা জানিছেন এবং অবিলম্বে আটক বিক্ষোভকারীদের মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেক এ সম্পর্কে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি একটি বৈশ্বিক মানবাধিকার। দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার কেড়ে না নিতে এবং অবিলম্বে নাভালানিকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ তেকে রাশিয়ার সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিভাগের প্রধঅন জোসেফ বোরেল, ‘ রাশিয়াতে সাম্প্রতিক ব্যাপক আটক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বল প্রয়োগ, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক অচল করে দেওয়ার ঘটনা অত্যন্ত পরিতাপ ও উদ্বেগজনক।
কে এই নাভালনি?
দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের কর্মী এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরোধী হিসেবে অত্যন্ত পরিচিত রাজনীতিক নাভালনি। ২০১৮ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াইয়ের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু অর্থ আত্মসাতের দায়ে দেশটির বিরোধী এই নেতাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখা হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাশিয়ার বিরোধী এই নেতার লাখ লাখ অনুসারী রয়েছেন। চলতি বছর সাইবেরিয়ার স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে নাভালনির কয়েকজন সমর্থক নির্বাচিত হয়েছেন।
গত বছরের আগস্টে বিষাক্ত নার্ভ অ্যাজেন্ট হামলায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিলেন নাভালানি। এই হামলার জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দায়ী করেন তিনি; যদিও ক্রেমলিন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সূত্র: বিবিসি
এসএমডব্লিউ