অভ্যুত্থানের মঞ্চ সর্বদাই প্রস্তুত ছিল মিয়ানমারে

২০১৫ সালে সরকারপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে অং সান সু চির অবস্থান সবসময়ই এক অনিশ্চয়তায় পূর্ণ ছিল। অর্ধ-শতাব্দীর স্বৈরশাসনের পর মিয়ানমারের নির্বাচনী গণতান্ত্রিক পালাবদলের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে উদযাপিত হলেও বাস্তবে সেনাবাহিনীর শক্তি কখনোই এতটুকুও হ্রাস পায়নি। দেশটিতে অভ্যুত্থানের হুমকি এবং কয়েক দশক ধরে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার দৃঢ় অবস্থান সর্বদা অটুট ছিল।
বিগত পাঁচ বছরে অং সান সু চি ২০০৮ সালে সামরিক বাহিনী প্রণীত সংবিধান মেনেই সরকার চালিয়েছেন। তাতে যে কোনো সময় সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ। প্রতিরক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থাকবে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সংবিধান সংশোধন করে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার লাগাম টেনে রেখে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের সব রকম ব্যবস্থা করেই রেখেছিল সামরিক বাহিনী।
ওই একই সংবিধানে এমন ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে, যাতে করে অং সান সু চি প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিয়ানমার শাসন করতে না পারেন। মূলত সূ চি কে লক্ষ্য করেই সামরিক বাহিনী সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদ যুক্ত করেছে। সংবিধান অনুযায়ী বিদেশি স্বজন আছে এমন কেউ মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। উল্লেখ্য, অং সান সু চির সন্তান ব্রিটিশ নাগরিক। মূলত, সু চি যাতে দেশের প্রেসিডেন্ট হতে না পারেন তার জন্যই এমন ব্যবস্থা।
এর পরিবর্তে সরকারে স্টেট কাউন্সেলর নামে একটি পদ তৈরি করে সু চিকে সেখানে বসানো হয়। এর মাধ্যমে সু চিকে এই বার্তাও সেনাবাহিনী দিয়ে রেখেছে যে, সে প্রকৃতপক্ষে কখনোই ক্ষমতার শীর্ষে থাকবে না। তার অবস্থা ভঙ্গুর। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয়, পার্লামেন্টে সেনা সমর্থন ছাড়া এই সংবিধান সংশোধন করাও সম্ভব না।
তবে সোমবার ভোরে সু চি’কে গ্রেপ্তার করে মিয়ানমারে যে অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটলো এর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোর জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দায়ও আছে।
কথিত ‘রাজনৈতিক উন্নয়নের’ আর গৃহবন্দী দশা থেকে সু চি’কে মুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে ২০১৩ সালে অন্ধের মতো দ্রুতগতিতে মিয়ানমারের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় ইইউ। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে ক্ষমতার রদবদল এবং ২০০৮ সালের বিতর্কিত ওই সংবিধান পুনরায় সংশোধনের মতো কোনো প্রতিশ্রুতি না নিয়েই সামরিক জান্তা শাসিত দেশটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাবর ‘এশিয়ার দিকে অগ্রগামী’ হওয়ার নীতির আওতায় ২০১৬ সালে একটি গণতান্ত্রিক মিয়ানমারে আশায় যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
ওই সময় অ্যাক্টিভিস্ট ও মানবাধিকারকর্মীরা এসব সিদ্ধান্ত তড়িঘড়ি করে নেওয়া হচ্ছে মর্মে সমালোচনা করে এর জন্য পরে পস্তাতে হবে বলে সতর্ক করে দিলেও তখন তাদের এই আহাজারিতে কেউ কর্ণপাত করেনি।
সু চি’ও অবশ্য বিশ্বাসঘাতকতাও করেছেন। ২০১০ সালে কারামুক্ত হওয়ার পর ২০১১ সালে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ২০০৮ সালে সামরিক বাহিনী প্রণীত সংবিধানের অধীনে তিনি কখনোই দেশ চালাবেন না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটা হয়নি। সংবিধান নিয়ে তো তিনি কোনো কথা বলেননি উল্টো জেনারেলদের পক্ষ নিয়েছেন।
অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরে এবং যুক্তরাষ্ট্রও মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে প্রস্তুত হওয়ায় সামরিক বাহিনীকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা ছাড়াই সু চি স্পষ্টতই অনুভব করেছিলেন যে, ২০০৮ সালের সংবিধানের অধীনে ক্ষমতা গ্রহণ করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই।
কাজেই সেনাবাহিনী এবং অং সান সু চি’র মধ্যে সম্পর্ক কখনো মসৃণ ছিল না। প্রয়োজনে একে অপরের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছে মাত্র। আন্তর্জাতিক সমালোচনা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা নিধন অভিযানসহ নানা ইস্যুতে শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চি নানাভাবে সামরিক বাহিনীর পক্ষ নিয়েছেন। তাদের দেখানো পথ অনুসরণ করেছেন।
সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা এবং তাদের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বরাবরের মতো অন্ধ থাকলে হয়তো ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারতেন সু চি। যে ক্ষমতায় আসার জন্য দশকের পর দশক ধরে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওই সময় কালে বহুবার তিনি সামরিক গৃহবন্দি হয়ে থেকেছেন। কিন্তু ভঙ্গুর ও হতাশার সরকার নিয়ে মিয়ানমারের মানুষ সু চি কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক উত্তরণের যে আশা করেছিল তা আশাই রয়ে গেল।
এএস