তুরস্কের ড্রোন কীভাবে একের পর এক যুদ্ধের মোড় বদলে দিচ্ছে?

রাশিয়ার সাথে যেকোন সময় যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে এ আশঙ্কায় ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে সম্ভাব্য লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে তুলছে নানা দেশ। তার মধ্যে একটি হচ্ছে তুরস্ক। তুরস্কের তৈরি ডজন ডজন ড্রোন ইতোমধ্যেই ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে।
আর শুধু তাই নয়, আঙ্কারা আর কিয়েভের মধ্যে একটি নতুন চুক্তিও হয়েছে যার ফলে ইউক্রেনের কারখানাতেই এখন তৈরি হবে তুরস্কের ডিজাইন করা ড্রোন। বিশ্বে যখন ড্রোন-যুদ্ধের গুরুত্ব ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে - তখন রাশিয়া-ইউক্রেন সম্ভাব্য সংঘাতও এর বাইরে থাকতে পারছে না। এই প্রেক্ষাপটে তুরস্কের এই ‘ড্রোন শক্তি’ সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?
রাশিয়া-ইউক্রেন সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের পটভূমিতে অনেকেই নজর রাখছেন কৃষ্ণসাগরের দক্ষিণের দেশ তুরস্ক ও তাদের তৈরি করা ড্রোনের দিকে। শুধু ইউক্রেন নয়, বস্তুতঃ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানা সংঘাতেই তুরস্কের তৈরি ড্রোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তুরস্ক এ ক্ষেত্রে কত বড় ‘প্লেয়ার’?
তুরস্ক সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশ এবং পশ্চিমা দেশগুলোর এই সামরিক কোয়ালিশনের একমাত্র মুসলিম সদস্যও। তুরস্কের সেনাবাহিনী হচ্ছে ন্যাটো জোটের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম - সংখ্যায় যার স্থান যুক্তরাষ্ট্রের পরই। এছাড়া তুরস্কের হাতে আছে তার ন্যাটো মিত্রদের মতই সামরিক প্রযুক্তি।

তুরস্কে বসবাসরত স্বাধীন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আরদা মেভলুতোগলু বলছেন, ‘আঙ্কারার সরকার গত ২০ বছরে একটা শক্তিশালী ড্রোন বাহিনী গড়ে তুলেছে। তারা তুরস্কের ভেতরে এবং বাইরে, কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী পিকেকের বিরুদ্ধে ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকেই - নিরাপত্তা কার্যক্রমে ড্রোন ব্যবহার করে আসছে।’
তিনি আরও বলছেন, ‘দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্পকে উন্নত করার জন্য ড্রোন প্রযুক্তিকে উৎপাদন ক্ষমতা এবং কার্যক্রম পরিচালনা, উভয় দিক থেকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তুরস্ক এই অঞ্চলে এক নজিরবিহীন অবস্থানে আছে। ব্যতিক্রম শুধু ইসরায়েল।’
তুরস্কের ড্রোন নির্মাতাদের সম্পর্কে আমরা কী জানি?
ইউএভি (আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল) বা মনুষ্যবিহীন আকাশযানকে চলতি কথায় বলা হচ্ছে ড্রোন। তুরস্কে ড্রোনের প্রধান উৎপাদনকারী হচ্ছে দু’টি। বায়কার ডিফেন্স নামের প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করে বায়রাক্তার টিবিটু এবং বায়রাক্তার আকিনচি নামে দু’টি ড্রোন। এগুলোর ব্যাপক চাহিদা আছে।
অন্য আরেকটি বড় উৎপাদনকারী হচ্ছে টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ। এদের তৈরি ড্রোনের নাম টিএআই আংকা এবং টিএআই আকসুংগুর। আরদা মেভুতোগলুর মতে, তুরস্কের সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো এরকম ১৫০টিরও বেশি ড্রোন ব্যবহার করছে। এ ছাড়াও তারা অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির পর্যবেক্ষণ এবং কামিকাজে ড্রোন ব্যবহার করছে।
ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক কতটা?
তুরস্ক ২০১৯ সাল থেকে ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের কাছে অনেকগুলো বায়রাক্তার টিবিটু অস্ত্রবাহী ড্রোন বিক্রি করেছে। ইউক্রেনও চায় একদিন তুরস্কের মতই ন্যাটোর সদস্য হতে। কিন্তু এখন তাদের একদিকে যেমন পূর্বাঞ্চলে রুশ-সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের তৈরি হতে হচ্ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে এক সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য।
কারণ রাশিয়া গত কয়েকমাস ধরে ইউক্রেন সীমান্তে এক লাখেরও বেশি সৈন্য মোতায়েন করেছে এবং তারা ইউক্রেনে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ন্যাটো জোট আশঙ্কা করছে। যদিও রাশিয়া এমন কোনো পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করে আসছে।
এই পরিস্থিতিতে গত ৩ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়েপ এরদোয়ান ইউক্রেন সফরে যান এবং ড্রোন বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে দু’দেশের মধ্যে একটি চুক্তি করেন। এসময় রয়টার্স বার্তাসংস্থাকে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, এই চুক্তির ফলে তুরস্কের উৎপাদনকারীদের জন্য ইউক্রেনে একটি ড্রোন কারখানা স্থাপনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এর ফলে ইউক্রেনেই ড্রোন নির্মিত হতে পারবে।
রাশিয়া একে কীভাবে দেখছে?
গত অক্টোবর মাসে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী একটি ভিডিও শেয়ার করে, যাতে দেখা যায় তুরস্কের তৈরি ড্রোন দিয়ে একটি ডি-৩০ হাউইটজার কামান ধ্বংস করা হচ্ছে। ওই কামান ইউক্রেনে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা ব্যবহার করে।
রুশ-নির্মিত আর্টিলারি সরঞ্জাম ধ্বংসের এই দাবির পর রাশিয়া এর সমালোচনা করে এবং ক্রেমলিন এক বিবৃতিতে তুরস্ককে হুঁশিয়ারি দেয় যে, তাদের তৈরি ড্রোন ওই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি করছে। আঙ্কারা ইতোমধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের কাছে ড্রোন বিক্রির ফলে ব্যাপারটা এখন জটিল হয়ে পড়েছে।
রাশিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই জটিল। বিশেষ করে সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে তা আরও জটিল হয়েছে। আঙ্কারা ও মস্কোর সিরিয়ায় পরস্পরবিরোধী স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই দু’টি দেশ আবার সম্পর্ক উন্নত করারও উদ্যোগ নিয়েছে।
রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ নামে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে তুরস্ক। এই উদ্যোগটিকে দেখা হয় রাশিয়ার সাথে এরদোয়ানের সম্পর্ক ভালো করার একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে।
তুরস্কের ড্রোন কি ইউক্রেনে ‘গেম-চেঞ্জার’ হয়ে উঠতে পারে?
ইউক্রেনে ঠিক কতগুলো বায়রাক্তার টিবিটু ড্রোন আছে তা ঠিক স্পষ্ট নয়। তবে আরদা মোভুতোগলু বলছেন, ‘ইউক্রেনের জন্য ডনবাস অঞ্চলে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে এই টিবিটু ড্রোন অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হতে পারে।’
এই ড্রোনে একটি অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তির ইলেকট্রো-অপটিক্যাল ক্যমেরা আছে। তার সাথে আছে ডাটা-লিংক সিস্টেম এবং দুই থেকে চারটি পর্যন্ত বিস্ফোরক - যা প্রিসিশন-গাইডেড অর্থাৎ উড়ে গিয়ে নির্ভুল নিশানায় লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে। এর ফলে এটা দিয়ে আগে থেকে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা যায় এবং তারপর দিক-নির্ণয় করে চলতে সক্ষম বোমা দিয়ে তাদের ওপর আঘাত হানা যায়।
মেভলুতোগলু বলছেন, এই সক্ষমতা বিশেষ করে সচল লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানার জন্য খুবই কার্যকর, বিশেষ করে ডনবাস এলাকায় যুদ্ধরত মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে। তবে তিনি বলছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেঁধে গেলে এসব ড্রোন কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ রাশিয়ার সামরিক বাহিনী সংখ্যার দিক থেকে যেমন, তেমনি প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও ইউক্রেনের চাইতে অনেকগুণ বেশি উন্নত।
কোন কোন দেশের হাতে তুরস্কের ড্রোন আছে?
ড্রোন বিক্রির ক্ষেত্রে তুরস্কের গ্রাহকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। তুরস্কের রফতানিসংক্রান্ত উপাত্তে ড্রোনের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই। কিন্তু ধারণা করা হয় যে, ১৫টিরও বেশি দেশ তুরস্কের তৈরি বায়রাক্তার এবং টিএআই ড্রোন কেনার জন্য অর্ডার দিয়েছে।
নিকট অতীতে সিরিয়া ও লিবিয়ার সংঘাতে এবং অতিসম্প্রতি নাগরনো কারাবাখের যুদ্ধে বায়রাক্তার টিবিটু ড্রোনের কার্যকর প্রয়োগ দেখা গেছে। আর এরপরই বিশ্বের বহু দেশে এই ড্রোনের চাহিদা বেড়ে গেছে।
নাগরনো কারাবাখে ৪৪ দিনের যুদ্ধে আজারবাইজানের সেনাবাহিনী আর্মেনিয়ার সৈন্য, সামরিক যান, কামান এবং বিমান-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালায়। এর সহায়তায় তারা বিতর্কিত ভূখণ্ড পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়। গত বছরের মে মাসে পোল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, তারা তুরস্কের কাছ থেকে ২৪টি সশস্ত্র ড্রোন কিনবে। এর ফলে পোল্যান্ডই হতে যাচ্ছে প্রথম ন্যাটো দেশ যারা তুর্কি ড্রোন কিনছে।
আফ্রিকাও তুরস্কের ড্রোনের একটি বড় বাজার
আরদা মেভলুতোগলু বলছেন, আফ্রিকার বাজারে তুরস্ক এখন চীনের উৎপাদকদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। তুরস্কের ড্রোনের দাম কম কিন্তু এসব অস্ত্রবাহী ড্রোনের পারফরম্যান্স ও মান ন্যাটোর সমতুল্য স্তরের।
সামরিক চুক্তিগুলোর বিস্তারিত খুব বেশি প্রকাশ করা হয় না। তবে তুরস্ক গত বছর ইথিওপিয়ার সাথে একটি প্রতিরক্ষা-সহযোগিতা চুক্তি করেছে এবং তাদের রফতানিও সহসাই অনেকটা বেড়ে গেছে। গত বছরই ইথিওপিয়ার কাছে তুরস্কের ড্রোন বিক্রি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এ সত্ত্বেও তুরস্ক তাদের সামরিক সরঞ্জামের নতুন নতুন বাজার খোঁজা অব্যাহত রাখবে বলেই মনে হয়।
মেভলুতোগলু বলছেন, ‘ড্রোন বিক্রি একদিকে যেমন সামরিক শিল্পের ক্ষেত্রে স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করবে, তেমনি গ্রহীতা দেশগুলোতে ও তাদের আশপাশে তুরস্কের সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতেও সুবিধা হবে।’
এ ক্ষেত্রে বাজার হিসেবে আফ্রিকার দিকে তুরস্ক নজর রাখছে। কারণ প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান স্বচক্ষে এর চাহিদা দেখেছেন। গত অক্টোবর মাসে এরদোয়ান এ্যাংগোলা, নাইজেরিয়া এবং টোগো সফরে গিয়েছিলেন। তখন তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘আফ্রিকায় যেখানেই আমি গিয়েছি, সবাই আমাকে ইউএভি নিয়ে প্রশ্ন করেছে।’
সূত্র : বিবিসি বাংলা
টিএম