বুলিং-র্যাগিং প্রতিরোধ নীতিমালা পাঠাতে হবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে

বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে নীতিমালার কপি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩ মাসের মধ্যে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে নীতিমালায় উল্লিখিত নিদের্শনা ৬ মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এ বিষয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে সোমবার (১৪ আগস্ট) বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
এর আগে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে চূড়ান্ত নীতিমালার গেজেটের কপি হাইকোর্টে দাখিল করা হয়।
গত ২৯ জুন গেজেট জারি করা হয়েছে। চূড়ান্ত নৗতিমালা বুলিং-র্যাগিংয়ের অপরাধে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং গভর্নিং বডির সদস্যদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী বুলিং-র্যাগিংয়ের মাত্রা অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যাবে।
চূড়ান্ত নীতিমালায় মৌখিক বুলিং-র্যাগিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কাউকে উদ্দেশ্য করে মানহানিকর/অপমানজনক এমন কিছু বলা বা লেখা, যা খারাপ কোনো কিছুর প্রতি ইঙ্গিত বহন করে ইত্যাদিকে মৌখিক বুলিং বুঝাবে। যেমন- উপহাস করা, খারাপ নামে সম্বোধন করা বা ডাকা, অশালীন শব্দ ব্যবহার করা, গালিগালাজ করা, হুমকি দেওয়া, শারীরিক অসমর্থতাকে নিয়ে উপহাস করা বা অনুরূপ কার্যাদি।
শারীরিক বুলিং ও র্যাগিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কাউকে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করা, চড়-থাপ্পড় মারা, শরীরে পানি বা রং ঢেলে দেওয়া, লাখি মারা, ধাক্কা মারা, খোঁচা দেওয়া, থুথু মারা, বেঁধে রাখা, কোনো বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে/বসে বা বিশেষ অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া অথবা কোনো কিছু করতে বা না করতে বাধ্য করা, কারো কোনো জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাওয়া বা ভেঙে ফেলা, মুখ বা হাত দিয়ে অশালীন বা অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি করা বা অনুরূপ কার্যাদি।
সামাজিক বুলিং ও র্যাগিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কারো সম্পর্কে গুজব ছড়ানো, প্রকাশ্যে কাউকে অপমান করা, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র, পেশা, গায়ের রং, অঞ্চল বা জাত তুলে কোনো কথা বলা বা অনুরূপ কার্যাদি।
সাইবার বুলিং-র্যাগিং সম্পর্কে বলা হয়েছে, কারও সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটু কিছু লোখা বা ছবি বা অশালীন ব্যঙ্গাত্মক কিছু পোস্ট করে তাকে অপদস্থ করা বা অনুরূপ কার্যাদি।
সেক্সুয়াল বুলিং ও র্যাগিং সম্পর্কে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আপত্তিজনক স্পর্শ করা বা করার চেষ্টা করা, ইঙ্গিতবাহী চিহ্ন প্রদর্শন করা, আঁচড় দেওয়া, জামা-কাপড় খুলে নেওয়া বা ঘুলতে বাধ্য করা বা অনুরূপ কার্যাদি। এছাড়া এমন কর্ম, আচরণ, কার্যাদি যা অসম্মানজনক, অপমানজনক ও মানহানিকর এবং শারীরিক/মানসিক যাতনার কারণ হতে পারে, যে নামেই হোক না কেন তা বুলিং ও র্যাগিং হিসেবে গণ্য হবে।
চূড়ান্ত নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে কমিটি গঠন এবং কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্তৃপক্ষ ৩-৫ সদস্য বিশিষ্ট বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ কমিটি বুলিং প্রতিরোধ কমিটি (এবিসি) কমিটি গঠন করতে হবে। প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ এক বা একাধিক কমিটি গঠন করতে পারবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে আত্মহত্যা, বুলিং ও র্যাগিং সংক্রান্ত যে কোনো ধরনের ইনজুরি প্রতিরোধ বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ কমিটি সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। শিক্ষা বৎসরের শুরুতেই কমিটি আবশ্যিকভাবে এবং পরে ৩ মাস অন্তর-অন্তর শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা/মতবিনিময় সভা/সেমিনার/সিম্পোজিয়াম/ওয়ার্কশপ আয়োজন করবে।
এ কমিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিং হয় কি না তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবেন। পর্যবেক্ষণের জন্য বুলিং/ র্যাগিং লগস তৈরি করবেন।
বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কর্তৃপক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে।
১. বুলিং এবং র্যাগিং উৎসাহিত হয় এরূপ কোনো কার্যকলাপ/সমাবেশ/অনুষ্ঠান করা যাবে না।
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যেসব জায়গায় বুলিং ও র্যাগিং হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেসব জায়গায় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে নজরদারির ব্যবস্থা করবে।
৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (আবাসিক হলসহ) কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে বুলিং ও র্যাগিংয়ের ঘটনার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করবে, অন্যথায় নিষ্ক্রিয়তার জন্য দায়ী হবে।
৪.বুলিং ও র্যাগিংয়ের উদাহরণ এবং পরিণতি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ ওয়েবসাইটে এবং প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে পোস্টারের মাধ্যমে প্রচারণা চালাবে। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে একদিন বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ ‘দিবস’ পালন করে বুলিং ও র্যাগিংয়ের সুফল সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবে।
৫. সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী/শিক্ষক/অভিভাবকদের শপথ নিতে হবে। পাঠকৃত শপথ পালনে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করাবেন এই মর্মে যে, তারা কখনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বুলিং ও র্যাগিং- করবে না, কাউকে বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার হতে দেখলে রিপোর্ট করবে, প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন।
৬. বুলিং ও র্যাগিংয়ের কুফল সম্পর্কিত সিনেমো, কার্টুন, টিভি সিরিজের প্রদর্শন, অনলাইনে দায়িত্বশীল আচরণের ব্যাপারে অনলাইন আচরণ সম্পর্কিত কর্মশালা ইত্যাদিসহ সহপাঠ্যক্রমিক কর্মশালা আয়োজনের নিমিত্ত কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৭. কর্তৃপক্ষ বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের ‘এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ’ এ অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করবেন। যেমন, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ও উদ্ভাধনী ক্ষমতাকে বিকশিত করা লক্ষ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড, বই পড়ার প্রতিযোগিতা, দাবা, খেলা কেরাম খেলা ও বিভিন্ন খেলাধুলা আয়োজন করবেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা এবং সহানভূতিশীলতার শিক্ষা দিতে বিভিন্ন সেচ্ছাসেবি কাজে নিযুক্ত করতে হবে।
৭. শিক্ষার্থীরা বুলিং/র্যাগিং এর কুফল কিংবা এর ফলে কীভাবে একজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া জন্য এবং সে সঙ্গে বুলিং ও র্যাগিং সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান তারা নিজেরাই বের করতে উদ্যোগী হওয়ার জন্য শিক্ষক রোল প্লে করবেন।
৮. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট কোনো শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। তাদের কাউন্সিলর হিসেবে অভিহিত করা হবে।
৯. বুলিং ও র্যাগিং নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
১০. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত বুলিং ও র্যাগিং বিষয়ে পরীবীক্ষণ করবেন এবং নীতিমালা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবেন।
চূড়ান্ত নীতিমালায় র্যাগিং বা বুলিং করলে তার বিরুদ্ধে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
১. বুলিং র্যাগিং এ কোনো শিক্ষক, অশিক্ষক অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন/বিধি অনুযায়ী শান্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২. বুলিং ও র্যাগিং এ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ/গভর্নিং বডি/ম্যানেজিং কমিটি/এডহক কমিটি/বিশেষ কমিটির কোনো সভাপতি/সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিধি, আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নীতিমালায় বুলিং সংক্রান্ত অভিযোগ দাখিল ও নিষ্পত্তির পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে
১. অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে আবেদন দাখিল করবেন।
২. বুলিং ও র্যাগিং সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ প্রাপ্ত হলে প্রতিষ্ঠান প্রধান কমিটি গঠন করে তদন্তের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৪.০ এর অধীন গঠিত কমিটিও তাদের কাছে উপস্থাপিত অভিযোগ তদন্ত পূর্বক প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিকট তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
৩. তদন্তকারী টিম বুলিং সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে সর্বোচ্চ ০৭ (সাত) দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে জমা দেবেন।
৪. প্রতিষ্ঠান প্রধান তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপনপূর্বক পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
৫. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে নীতিমালায় বর্ণিত পদক্ষেপসমূহ কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় অর্থ সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহন করবে। সরকার প্রয়োজন মোতাবেক সময়ে সময়ে প্রণীত নীতিমালাটি পরিবর্তন/সংযোজন/বিয়োজন পারবেন।
হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছিলেন
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার পর ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দেন হাইকোর্ট। আদেশে ‘বুলিং’ ও শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায় নির্ণয়ে একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরির জন্য অতিরিক্ত শিক্ষাসচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেন আদালত। নির্দেশ অনুযায়ী এই কমিটি একটি নীতিমালা খসড়া করে ২০১৯ সালে আদালতে দাখিল করে। এরপর নীতিমালা কয়েক দফা সংশোধন, পরিমার্জন, সংযোজন-বিয়োজন করা হয়। এর মধ্যে ২০২১ সালে বুলিং নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. তানভির আহমেদের রিটে ওই বছর ২২ আগস্ট হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। ‘বুলিং’ থেকে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং রোধে নীতিমালা তৈরি করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তা-ও জানতে চাওয়া হয়। বিষয়বস্তু একই হওয়ায় দুটি মামলা গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক- আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। সেদিন শিক্ষামন্ত্রণালয় পঞ্চম দফায় নীতিমালার খসড়া জমা দেয়। কিন্তু কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সেসব বিষয় সংশোধন, পরিমার্জন করে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করতে আদালত ফের সময় দেন। অবশেষে চূড়ান্ত নীতিমালার গেজেট হাইকোর্টে দাখিল করা হলো।
এমএইচডি/এসএম