শিশুদের অধিকার আদায়ে লড়াই করা এক আইনজীবী মা

অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন আইনজীবী। বাবা রাশিদুল হাসানও আইনজীবী। স্বামী শেখ সাদী রহমান সিনিয়র সহকারী জজ। পারিবারিক জীবনে দুই সন্তানের মা এই আইনজীবী। উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রিট মামলা করে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। পেয়েছেন দেশজুড়ে পরিচিতি। পেশার প্রতি আন্তরিকতা ও কঠোর পরিশ্রম তাকে সাফল্য এনে দিয়েছে।
ইশরাত হাসানের বড় ছেলে উমাইর বিন সাদী। মাত্র ৯ মাস বয়সে শিশু উমাইর নিরাপদ পরিবেশে মায়ের বুকের দুধ পানের অধিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট করে। শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই করেন মা ইশরাত হাসান। যার ফলে হাইকোর্ট সব কর্মস্থলে, বিমানবন্দরে, রেল স্টেশনে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার স্থাপনের জন্য ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে আইনি লড়াই করার করার কারণে আন্তর্জাতিক প্রোবোনো অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন তিনি। তার ছোট ছেলে নুবাইদ বিন সাদী ৬ মাস বয়সে পিতৃত্বকালীন ছুটির দাবিতে হাইকোর্টে রিট করে। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট পিতৃত্বকালীন ছুটি দিতে রুল জারি করেছেন। এই মামলারও আইনজীবী ইশরাত হাসান নিজেই। মা দিবসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন সংগ্রামী এই আইনজীবী মা।
ঢাকা পোস্ট : আইন পেশা কেন বেছে নিলেন?
ইশরাত হাসান : আইনজীবী পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে স্বভাবতই আইন পেশার দিকে বিশেষ ঝোঁক ছিল। আমার দাদা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। আমার বাবাও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তাদের দেখে ছোটবেলা থেকেই এই পেশার প্রতি আকর্ষণবোধ করি। এছাড়া, কিছু পেশার মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা যায়। বিশেষ করে অসহায় ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করার ব্যাপক সুযোগ আইন পেশায় রয়েছে। এ কারণে আইন পেশা বেছে নিয়েছি।
ঢাকা পোস্ট : সংসার বিয়ে ও সন্তানের তথ্য জানতে চাই...
ইশরাত হাসান : আমার বিয়ে হয় ২০১৮ সালে। আমার স্বামী বর্তমানে বিচারক হিসেবে বিচার বিভাগে কর্মরত। আমাদের সংসারে আলো ছড়াচ্ছে দুই পুত্র সন্তান উমাইর বিন সাদী এবং নুবাইদ বিন সাদী। তাদের বয়স যথাক্রমে এখন ৬ বছর ও ১ বছর।
ঢাকা পোস্ট : কাজের পাশাপাশি সন্তানকে কীভাবে সামলান, সংসারে কীভাবে ব্যালেন্স করেন?
ইশরাত হাসান : কর্মজীবী নারীদের জীবন সত্যিই অনেক কঠিন। আইনপেশা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং পেশা। এ পেশায় শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি প্রচুর মানসিক চাপ নিতে হয়। এছাড়া, নিয়মিত পড়াশোনা করে যেতে হয়। যার ফলে, সংসারে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া কঠিন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। সঙ্গে প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল। আমার পরিবারের সবাই সহযোগিতা করেন। যার ফলে সংসার ও পেশার মধ্যে ব্যালেন্স করতে পারছি।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্ট : বিয়ের কারণে বা শ্বশুরবাড়ির কারণে পেশাগত জীবন বিঘ্নিত হয় কি না, তাদের সাপোর্ট কেমন পান?
ইশরাত হাসান : আমি মনে করি নারীদের ক্যারিয়ারের জন্য বিয়ে বাধা নয়। মূল সমস্যা হলো- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির অসযোগিতামূলক আচরণ। আবার মেয়েরা সেসব মেনে নিয়ে নিজের প্রতি অবিচার করে। আমার ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি এবং পাচ্ছি।
ঢাকা পোস্ট : বিবাহিত পেশাজীবী নারীদের/মা’দের প্রতি আপনার বার্তা কী?
ইশরাত হাসান : পারিবারিক ও পেশাগত জীবন দুটো মিলিয়েই একজন নারীর জীবন। কোনো একটা, আরেকটার জন্য ছেড়ে দেওয়া সফলতা নয়। নিজের আত্মসম্মানের জায়গাটা বজায় রাখতে হবে। যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে সব কিছুই অর্জন করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
ঢাকা পোস্ট : শিশু সন্তান নিয়ে আইনি লড়াইয়ের গল্পটা শুনতে চাই...
ইশরাত হাসান : আমার ছেলে উমাইর বিন সাদীর বয়স যখন ৯ মাস তখন আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম কক্সবাজারে। বেড়ানো শেষে ঢাকায় ফেরার পথে কক্সবাজার বিমানবন্দরে এসে মারাত্মক বিপাকে পড়ি। প্রচণ্ড ক্ষুধায় কান্না জুড়ে দেয় আমার অবুঝ সন্তান। তাকে বুকের দুধ পান করানোর মতো কোনো নিরাপদ স্থান পাচ্ছিলাম না। এদিকে উমাইরয়ের কান্না বেড়েই চলছিল। শেষ পর্যন্ত বিমানবন্দরে নারী যাত্রীদের চেকিংয়ে দায়িত্বরত এক কর্মীকে রাজি করিয়ে চেকিংয়ের জন্য নির্ধারিত পর্দা ঘেরাও করা স্থানে কোনোরকমে বুকের দুধ পান করাই। সেই অসহায় মুহূর্তে দেশের সব মা-শিশুদের এ অবস্থার প্রতিকারের জন্য আইনি লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেই। পরে নিরাপদ পরিবেশে শিশুর বুকের দুধপানের অধিকার চেয়ে আমি ও আমার ৯ মাস বয়সী ছেলে উমাইর বিন সাদী হাইকোর্টে রিট আবেদন করি।
রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, আদালত সন্তুষ্ট হয়ে রুল জারি ও অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন। পরে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসের ২ তারিখ হাইকোর্ট সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং পাবলিক প্লেসে ব্রেস্ট ফিডিং রুম স্থাপনের নির্দেশনা দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। ইতোমধ্যে দেশের সব বিমানবন্দর, রেলওয়ে স্টেশন এবং জেলা আদালতসমূহে ব্রেস্ট ফিডিং রুম স্থাপিত হয়েছে। অনেক হাসপাতাল, ব্যাংক, শপিং মলসহ অনেক জনসমাগমস্থলে ব্রেস্ট ফিডিং রুম স্থাপন হয়ে গেছে। এ রিট দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বার অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমাকে প্রোবোনো অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। প্রথম বাংলাদেশি আইনজীবী হিসেবে আমি বাংলাদেশের পক্ষে এই আন্তর্জাতিক পুরস্কার গ্রহণ করি।
ঢাকা পোস্ট : ছোট সন্তানকে নিয়েও একটি রিট করেছিলেন, সে বিষয়ে জানতে চাই..
ইশরাত হাসান : হ্যাঁ, আমি পিতৃত্বকালীন ছুটির দাবিতে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করি। এই রিটের পিটিশনার ছিল আমার ৬ মাস বয়সী শিশু নুবাইদ বিন সাদী। এই রিটের কারণ, বাবা-মায়ের দুজনেরই শিশুর বেড়ে ওঠার প্রাথমিক সময়ে ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি থাকলেও পিতৃত্বকালীন ছুটির কোনো সুযোগ নেই। অথচ অনেক উন্নত দেশেই এই ছুটি দেওয়া বাধ্যতামূলক। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছি, একজন মা যদি নবজাতকের সঙ্গে মানসিক ও শারীরিকভাবে সংযুক্ত থাকতে পারেন, তাহলে একজন বাবাও সন্তান পালনে দায়িত্বশীল ও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন।
এই রিটে আমি চেয়েছি, সরকারি-বেসরকারি সব কর্মক্ষেত্রে শিশুর জন্মের পর পিতাকে নির্দিষ্ট সময়ের ছুটি দেওয়ার আইনি নিশ্চয়তা। এতে বাবা শিশুকে সঙ্গ দিতে পারবেন, স্ত্রীর পাশে থাকতে পারবেন এবং পরিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় হবে। এই রিটটি এখনো বিচারাধীন। তবে এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে এবং আমি আশা করি, একদিন কর্মজীবী পিতাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে পিতৃত্বকালীন ছুটি। বিষয়টি নিয়ে সমাজে ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয়েছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে মনে করি। আশা করি, এই রিটের মাধ্যমে আমাদের সমাজে পরিবারবান্ধব কর্মসংস্কৃতি গড়ে উঠবে, যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সহায়ক হবে।
এমএইচডি/এমএ