বিচার বিভাগে দ্বৈত শাসনের অবসান, আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত

‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ’ দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক সোনালী সংযোজন, যুগান্তকারী ঘটনা। এই অধ্যাদেশের ফলে বিচার বিভাগে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটেছে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঐতিহাসিক এই অধ্যাদেশ জারির ফলে নিম্ন আদালত প্রশাসনিক কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ জারির বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল পদমর্যাদার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা মনে করি জাতির জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে এবং দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটা সোনালী সংযোজন হয়েছে। সরকারের যা করার ছিল সেটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে তারা করে দিয়েছেন। তাই বিচার বিভাগের দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা বেড়ে গেল। বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর আমরা আশা করবো বিচার বিভাগে সেই সমস্ত বিচারকরাই আসবেন যারা শুধু বিবেক, সংবিধান ও আইনের কাছে জবাবদিহি করবেন। অন্য কারও কাছে তিনি দায়বদ্ধ থাকবেন না। যারা অতীতে বিচার বিভাগকে কলঙ্কিত করেছেন এরকম কোনো বিচারক আর বিচার বিভাগে আসবে না। এখন বিচার বিভাগে সুদিন দেখার প্রত্যাশা করছি আমরা।
অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আমি বিশ্বাস করি, এই অধ্যাদেশের ফলে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটবে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিচার বিভাগের ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। তবে সঠিক বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে এর কার্যকারিতা। এই অধ্যাদেশে জারির জন্য আমি প্রধান বিচারপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।
বিচার বিভাগ পৃথককরণ মামলার বাদী ও সাবেক বিচারক মাসদার হোসেন সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ জারি বিষয়ে বলেন, এটা শুধু জুডিশিয়ারিরই নয়, সারা দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল। এই অধ্যাদেশ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানাই।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির অধ্যাদেশ জারির পর বলেন, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে আমাদের নিম্ন আদালত প্রশাসনিক কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি পেল। আর অধস্থন বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ও ছুটিবিষয়ক সব সিদ্ধান্ত উচ্চ আদালতের নিয়ন্ত্রণে এলো।
গতকাল বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি হয়েছে। বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বতন্ত্রীকরণ নিশ্চিতকরণে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের উদ্যোগে সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। একপর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের দশদিন পর ৩০ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয় এ অধ্যাদেশ জারি করে।
এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বিচারকাজে নিয়োজিত বিচারকদের পদায়ন, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ও ছুটিবিষয়ক সব সিদ্ধান্ত ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় এই সচিবালয়ের হাতে থাকবে। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সচিবালয়ের সচিব প্রশাসনিক প্রধান হবেন।
১৯৯৫ সালে বিসিএস বিচার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মাসদার হোসেন ও তার সহকর্মীরা বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথককরণে মামলা করেন। সেই মামলায় ১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক রায় দেয়। এই রায়ের আট বছর পর ২০০৭ সালে মূল নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়।
গত ২ সেপ্টেম্বর অধস্তন আদালতের দায়িত্বপালনরত বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, দান ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান সম্বলিত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের সংশোধনী অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করে এবং বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ১১৬ অনুচ্ছেদ বহাল করে বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।
রায়ে সুপ্রিম কোর্টের অধীন সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের পাঠানো প্রস্তাবনা অনুসারে তিন মাসের মধ্যে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এমএইচডি/এসএম
