করোনা পরীক্ষার কিট ক্রয়ে দরপত্র বাতিলে রিট

করোনা পরীক্ষার কিট ক্রয়ে সাজানো দরপত্র বাতিল এবং করোনা সংক্রান্ত ক্রয় প্রক্রিয়ায় সংঘটিত দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট দায়ের করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) মানবাধিকার সংগঠন ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির পল্লব এ রিট দায়ের করেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, আইইডিসি আর এর পরিচালক, কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক, চীনের সান সিউর বায়োটেক কোম্পানির বাংলাদেশি এজেন্ট ওভারসিজ মার্কেটিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে রিটে বিবাদী করা হয়েছে।
আইনজীবী বলেন, করোনাকালীন বিভিন্ন মেডিকেল সামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। শত শত কোটি টাকা লুটপাট আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। করোনা মোকাবিলায় একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী হলো করোনা শনাক্তকরণের সঠিক মানসম্পন্ন কিটের ব্যবহার। এসব কিট ক্রয় করার জন্য কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কর্তৃপক্ষ শুরু থেকে অদ্যাবধি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির মাধ্যমে ক্রয় করতো। কিন্তু ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের পর করোনা শনাক্তকরণের আরটিপিসিআর কিট উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় ক্রয়ের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কর্তৃপক্ষ।
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ২২ আগস্ট তিনটি লটে ১৮০ কোটি টাকার ২০ লাখ কিট কেনার জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল সিন্ডিকেট বাণিজ্যের পরিবর্তে মরণঘাতী করোনা মহামারি প্রতিরোধ এবং ব্যবস্থাপনায় সরকারের গৃহীত জনকল্যাণমূলক প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে মানসম্পন্ন কিট কেনা হবে। কিন্তু দরপত্রের শর্তের বেড়াজালে আটকে দেওয়া হয়েছে সুলভ মূল্যে গুণগত মানসম্পন্ন কিট ক্রয়ের সম্ভাবনা।
বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় একটি নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটকে বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি আমলে নিয়েছে ল' অ্যান্ড লাইভ ফাউন্ডেশন। ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের প্রাথমিক গবেষণায় মানসম্মত কিট ক্রয়ের ক্ষেত্রে অনিয়মের চিত্রটি প্রতীয়মান হয়েছে।
প্রত্যেকটি কিটের বাজারমূল্য মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা হলেও শুরুতে প্রতিটি কিট ক্রয় করা হয়েছে ৩ হাজার টাকার ওপরে। এভাবে স্বাস্থ্য খাতের একটি সিন্ডিকেট এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ শত কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে লুটপাট করেছে। বর্তমানে চীনের সানসিউর বায়োটেক নামের একটি কোম্পানির উৎপাদিত এবং সরবরাহকরা আরটিপিসিআর কিট ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই কোম্পানির বাংলাদেশের এজেন্ট ওভারসিজ মার্কেটিং করপোরেশন। সানসিওর বায়োটেক কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ইউজার ম্যানুয়াল থেকে দেখা যায় এ কিট করোনা রোগী শনাক্তের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল। কারণ কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রতি মিলি লিটারে ২০০ কপি আর এন এ ভাইরাল উপস্থিতি থাকলেই কেবল পজিটিভ রিপোর্ট আসবে। কিন্তু প্রতি মিলি লিটারে ২০০ কপি আর এন এ ভাইরাল না থাকলে করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে। অথচ এমনও কিট উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে যাদের কিট কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রতি মিলি লিটারে ১০০ কপি আর এন এ ভাইরাল উপস্থিত থাকলেই করোনা শনাক্ত করতে পারবে।
সানসিউর কোম্পানির ইউজার ম্যানুয়াল অনুযায়ী তাদের উৎপাদিত কিট শতভাগ করোনা শনাক্ত করতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের আইইডিসিআর সান সিউর কোম্পানির উৎপাদিত টেস্ট কিটকে শতভাগ শনাক্তের সার্টিফিকেট দিয়েছে, যা অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলেই মনে হয়।
ফলে প্রথম থেকেই বাংলাদেশে করোনার টেস্টের রিপোর্টে সঠিকভাবে করোনা শনাক্ত করা যায়নি। অনেকে করোনা হওয়া সত্ত্বেও কিটের দুর্বলতার কারণে রিপোর্টে ভুলভাবে নেগেটিভ ফলাফল এসেছে। কাজেই নেগেটিভ ফলাফল আসার কারণে তিনি আক্রান্ত হলেও জানতে পারেনি এবং তার নিজ পরিবার ও অসংখ্য মানুষকে তিনি করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। এভাবে করোনা সংক্রমণ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক বিদেশগামী মানুষ করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে বিদেশে গমন করার পরে সংশ্লিষ্ট দেশে উন্নতমানের কিট ব্যবহার করে যখন পরীক্ষা করা হয়েছে তখন তাদের করোনা শনাক্ত হয়েছে। ফলে করোনা শনাক্তকরণে বাংলাদেশের সক্ষমতা এবং স্বচ্ছতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সারাবিশ্বে ব্যাপক ভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সঠিক গুণগত মানসম্পন্ন কিট ব্যবহার করে করোনা শনাক্ত করা গেলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও বেশি উজ্জ্বল হত।
মেডিকেল সরঞ্জামাদি ও ওষুধ পত্রের মান নিয়ন্ত্রণ এবং সনদ প্রদানে বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও স্বনামধন্য সংস্থা হলো যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ। ওই সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত এবং সনদপ্রাপ্ত অনেক করোনা টেস্ট কিট থাকা সত্ত্বেও মানসম্পন্ন কিট ব্যবহারে আইইডিসিআর অনুমোদন দেয়নি। গুটিকয়েক অখ্যাত কোম্পানির টেস্ট কিট আইইডিসিআর কর্তৃক অনুমোদিত হলেও সানসিউর বায়োটেক কোম্পানির কিট ছাড়া অন্য কোনো কিট সরবরাহের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
দরপত্রের শর্তাবলীতে বিগত এক বছরে বাংলাদেশে এ ধরনের কিট সরবরাহের সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যে অভিজ্ঞতা কেবল সান সিওর কোম্পানিরই রয়েছে।
ফলে ২০ লাখ আর টি পি সি আর কিট ক্রয়ের দরপত্রে সান সিউর বায়োটেক ছাড়া অন্য কোন কোম্পানির কিট সরবরাহের কোনো সুযোগ নেই।
অধিকন্তু একটি সিন্ডিকেটকে দরপত্র পাইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে শর্তাবলীতে অযাচিত সংশোধনী এনে কিটের বিশুদ্ধতার সমর্থনে সংশ্লিষ্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সনদপত্র দেওয়ার শর্ত বিলোপ করা হয়েছে, যা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর ৪৯ বিধির চরম লঙ্ঘন।
এসব অসঙ্গতি তুলে ধরে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কর্তৃক প্রকাশিত দরপত্র বাতিল, নতুন দরপত্র আহ্বান, করোনাকালীন পরীক্ষার কিট ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম তদন্তের জন্য কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে রিট দায়ের করা হয়েছে।
এমএইচডি/এসএম