ঈদেও যাদের ছুটি নেই
ঈদ সবার প্রাণের উৎসব হলেও এমন কিছু পেশা আছে, যেসব পেশায় ঈদে ছুটি মেলে না। ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ এক ঈদে ছুটি পেলেও, আরেক ঈদে পান না কিংবা এক বছরে ছুটি পেলে হয়তো পরবর্তী দু-তিন বছরে আর ছুটি পান না। এসব পেশার মানুষের জন্য ঈদ ব্যপারটা আনন্দের পাশাপাশি কিছুটা কষ্টেরও। ঈদ মানেই বাড়ি ফেরার টান। কিন্তু তারা ঘরে ফিরতে পারেন না, পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারেন না। এসব ঘিরে রয়েছে তাদের নানাবিধ গল্প, অনুভূতি। চলুন এমন কিছু পেশাজীবী মানুষের অনুভূতি জেনে নেওয়া যাক, যারা আসন্ন ঈদেও বাড়ি যেতে পারবেন না, পরিবারের সাথে ঈদ পালন করতে পারবে না।
আব্দুল্লাহিল মারুফ। তিনি তাইহুয়া শিপ ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড-এর মার্চেন্ট মেরিন অফিসার (সেকেন্ড অফিসার)। বছরের বেশিরভাগ সময় তাকে সমুদ্রেই কাটাতে হয়। বছরের পর বছর সমুদ্রের জলরাশি দেখতে দেখতেই কেটে যায় তার ঈদের দিন। তার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন- অনেক বছর ধরে জাহাজে কাজ করছি। ঈদ কিংবা বাঙালির বেশিরভাগ উৎসবেই বাংলাদেশে পরিবারের কাছে থাকার সুযোগ হয় না। প্রথম প্রথম বেশি খারাপ লাগতো। এখন অনুভূতি অনেকটা ভোঁতা হয়ে গেছে, তবু কিছুটা কষ্ট তো হয়ই ঈদের মতো সবচেয়ে বড় আনন্দের উৎসবে পরিবারের সঙ্গে থাকতে না পেরে। তিনি আরো জানালেন, টানা চার বছর পর গতবার তিনি পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পেরেছিলেন। সেজন্য তাকে ডাবল সিফট অর্থাৎ টানা এক বছর সমুদ্রে থাকতে হয়েছিল, তারপর ঈদের সময় ছুটি মিলেছিল। এ বছর ঈদে আর সেই সুযোগ নেই, সমুদ্রেই কাটাতে হবে। তিনি বলেন, জাহাজে থাকতে থাকতে এখানকার মানুষগুলোকে নিয়ে একটা আলাদা জগৎ বা পরিবার তৈরি হয়ে যায়। তাই একদম নিরানন্দও লাগে না। রোজকার মতোই ডিউটি পালন করি, এর ভেতরেই কোথাও একটা ঈদের আনন্দ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এইতো নাবিক জীবনের ঈদ।
ফাহমিদা মেহজাবিন নিপু। টিম মেম্বার হিসেবে কর্মরত আছেন বিএফসিতে। তিনি বলেন, এসব সেক্টরে সাধারণত ঈদের ছুটি দেয় না, বরাবর এটা জেনেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। তবে ঈদের পরে আস্তে ধীরে ছুটি নিয়ে সময় কাটাতে চাই। মানুষ কীভাবে উপভোগ করে, সেটাও দেখার ইচ্ছা আছে। তবে প্রিয়জন, পরিবার ছেড়ে ঈদ করতে হবে, খারাপ তো লাগবেই খুব। বিশেষ করে বাবা-মা, বেশি খারাপ লাগবে তারা কষ্ট পাবে এটা ভেবেই। তবুও বোঝানোর চেষ্টা করবো। তবে ফুড সেক্টরে যেকোনো এক ঈদে ছুটি নেওয়া যায়। ইনশাআল্লাহ্ কুরবানী ঈদে আরো ভালো সুযোগ হবে ভালোভাবে ঈদ উদযাপনের।
অপর্না সরকার নিশা। Playground Attendant (PGA) হিসেবে ঢাকার একটা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে (প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কর্মরত আছেন। তিনি বলেন, ঈদে এলে ছুটি কখনোই পাই না, তাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। প্রথমে বেশি খারাপ লাগতো, এখন অতটা লাগে না। ঈদে সবাই মজা করছে পরিবারের সঙ্গে, কিন্তু আমি পারছি না, এটা দেখলে কিছুটা কষ্ট তো হয়ই। তবে ঈদের পরে ছুটি নিয়ে সময় দিতে পারবো আপনজনদের, এ আশায়ই আছি।
যুথী রায়। পেশায় তিনি নার্স। ফরিদপুরের একটি হাসপাতালে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কর্মরত আছেন। যদিও তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বী, তবু ঈদকে ঘিরে তারও সবসময় আনন্দ উত্তেজনা কাজ করে। যখন স্টুডেন্ট ছিলেন, তখন ঈদের ছুটিতে পরিবারের কাছে যেতেন, মুসলমান বন্ধুদের বাড়ি ঘুরতে যেতেন ঈদের দিন। সবাই মিলে খুব মজা করতেন। কিন্তু এখন কর্মজীবনের জন্য তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। তিনি বলেন, সবাই ছুটি পাবে, যে যার বাড়িতে ভালো সময় কাটাবে, এটা ভাবলে খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু যে মানুষগুলো হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকবে, তাদের সেবা করতে পারবো, তাদের পাশে থাকতে পারবো। যখন একজন মানুষকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠাতে পারি, তখন মনের মধ্যে অজানা একটা ভালোলাগা কাজ করে। তখন আর মনেই হয় না যে, ঈদে আমি ছুটি পাইনি। এটাও একধরণের আত্মতৃপ্তি।
পুলিশ কর্মকর্তা শামীম আহমেদ বলেন, পুলিশের চাকরি করার সুবাদে বেশিরভাগ ঈদেই ছুটি মেলে না, এক ঈদে ছুটি পেলে আরেক ঈদে পাওয়া যায় না, কখনো আবার কোনো ঈদেই পরিবারের কাছে যাওয়ার সুযোগ হয় না। ব্যপারটা অবশ্যই খুব কষ্টদায়ক। তবে দেশের মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে, তাদের সুষ্ঠুভাবে ঈদ উদযাপন করা নিশ্চিত করতে এ কষ্টটুকু হাসিমুখেই মেনে নিই।
ঈদ সবার জন্য ঘরমুখী হয় না। এসব পেশার মতো আরো অনেক পেশার মানুষ যেমন, সাংবাদিক, চিকিৎসক এমন অনেকেই ঈদে ছুটি পান না। তারা মানুষের সেবার প্রয়োজনে থেকে যান স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে। এসব নিবেদিতপ্রাণ মানুষের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে দেশ।
