নাবিলা, তুই আমার হাতটা ধরে রাখ
ভালেবাসার ঋণে ভীষণ ভারাক্রান্ত লাগে বলেই বোধ হয় মনুষ্য হৃদয়ের উষ্ণতা থেকে নিজেকে আগলে রাখতে চাই সযত্নে। তবু কীভাবে যেন মেয়েটি এসে দখল গড়ে নিল ভেতরে। বলছি বছর দশেক আগের কথা, দাখিল মাদরাসার গণ্ডি পেরিয়ে আলিমে ভর্তি হয়েছি মাত্র। সদ্য ভর্তি হওয়া আমার সঙ্গে পরিচিত হতে এগিয়ে এলো নাবিলা নামের এক সহপাঠী। ‘শোনো, আজ থেকে আমরা প্রমিত ভাষায় কথা বলবো, কেমন?’ পরিচয়পর্ব শেষে এই ছিল তার প্রথম দিনের প্রস্তাব। সহপাঠী থেকে বন্ধু হয়ে ওঠার সেই-ই শুরু।
কিছুদিন যেতেই আবিষ্কার করলাম আমাদের প্রচুর কথা আছে, নিজেদের সঙ্গে বলার মতো। প্রচুর পাগলামোর ধাত আছে, একসঙ্গে করার মতো। ক্লাসের ফাঁকে পাশাপাশি বসে সারাক্ষণ আড্ডা আর অদ্ভূত সব কর্মকান্ডের পরও ক্লাস শেষে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে চারদিকের ভীড় আর মোটর গাড়ির টুংটাং আওয়াজের মাঝেও থামতো না আমাদের কথার গাড়ি।
‘নাবিলা, তুই আমার হাতটা ধরে রাখ, আমার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না!’ - সদ্য কৈশোর পেরোনো অবুঝ মনের একান্ত যন্ত্রণাগুলো এভাবেই কত কথার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নিয়েছি প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে। সায়ানের গানের মতো আমার দুঃখগুলোতে অংশ ছিল ওরও।
আলিম ক্লাসের দু’বছর দেখতে দেখতেই কেটে গেল। জীবনের গতি সরিয়ে নিয়ে গেলো দুজনকে দু'দিকে। দূরে যাওয়ার পরও মূলত আমরা দূরে চলে যেতে পারি না। দুই বান্ধবী এখন দু’শহরে থাকি। অথচ বন্ধুহীন ক্যাম্পাসে একা একা হাঁটতে গেলেও আমি ভাবি, অন্য এক শহরে অনেক দূরে থেকেও একটা মেয়ে আমাকে খুব ভাবছে। তাহাজ্জুদের প্রার্থনায় আমার জন্য কাঁদছে। এরচেয়ে ভালো বন্ধুত্বের সংজ্ঞা সত্যিই আমার জানা নেই। ভীষণ পাগলাটে মেয়েটি মাঝরাতে হুটহাট ফোন দিয়ে বলবে- ‘তুই হাসতে থাক! কোন কথা বলা লাগবেনা, আমি তোর হাসি শুনি!’
মেয়েটির স্বপ্ন, কোনো একদিন আমাদের স্বপ্নের নীড় পাশাপাশি হবে। ‘সাংসারিক’ কাজের ফাঁকে দুই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দু’জন গল্প করবো। আনন্দের, কষ্টের, বিষাদের, অশ্রুর আর অনাবিল হাসির সব গল্প। মেয়েটি একটা একটা করে গল্প জমাচ্ছে সেদিনের জন্য। ওর এই অদ্ভূত স্বপ্নের কথা শুনি! আর অবাক হই, ‘আমাকে নিয়েও কেউ স্বপ্ন দ্যাখে, গল্প বোনে!’ জানি, এখন আমি পৃথিবী ছেড়ে গেলে মেয়েটি সবার আড়ালে গিয়ে কাঁদবে! তাঁর সাশ্রু প্রার্থনায় আমিও থাকবো।
কখনো মুঠোফোনে কল দিয়ে বলে উঠবে, ‘জানিস, আমি স্বপ্ন দেখলাম, তুই কোনো ঝড়ের মাঝে আটকা পড়েছিস যেন’। জীবনের উত্থান-পতনে যখন প্রবল খরতাপে পুড়ি, মেয়েটিকে জ্বালাবো না ভেবে কিছু না বললেও বিধাতার অসীম খেয়ালে সে এভাবেই যেন জেনে যায় সব।
প্রায়ই ভাবি, বন্ধুত্বের জন্য হয়তো কাছাকাছি থাকার দরকার হয় না সবসময়। গলায় আটকে থাকা কান্না আর জীবনের রোজকার উচ্ছ্বাস, আনন্দ সবকিছু স্বাচ্ছ্বন্দ্যে জমা রাখার এক অদ্ভূত সুন্দর সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব। অনেক দূরে থেকেও মেয়েটিকে অনেক বেশি ভালোবাসি। জীবনের সব খরতাপে প্রবল ভালোবাসারা ছায়া হয়ে তোকে আগলে রাখুক, নাবিলা! এই-ই আমার আপ্রাণ প্রার্থনা। কুমার বিশ্বজিতের গলায় ভেসে আসা গানের মতো করে বলতে চাই - ‘বন্ধুরে তোর লাগি এই গান গাওয়া, বন্ধুরে তোর লাগি এই পথ চাওয়া’।
সাবেক শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
