জৌলুশ হারাচ্ছে লিটল ম্যাগ চত্বর
২০০৬ সাল থেকে বইমেলায় বাংলা একাডেমির সংশ্লিষ্টতায় সংযোজিত হয় লিটল ম্যাগ চত্বর। একসময় লিটল ম্যাগ চত্বরে দিনভর আড্ডা চলতো তরুণ লেখক ও প্রকাশকদের। তরুণ পাঠকরাও ভিড় করতেন এখানে। সচেতন পাঠক ও লেখকদের মধ্যে চলত সমসাময়িক বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক। প্রথাবিরোধী প্রকাশনার কারণে সাহসী ও সংস্কারপন্থি লেখক ও পাঠকদের মূল আবেগের জায়গা ছিল লিটল ম্যাগাজিন। কিন্তু কাল পরিক্রমায় জৌলুশ হারাচ্ছে সাহিত্যের এই ছোট কাগজ।
শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বইমেলায় লিটল ম্যাগ চত্বর ঘুরে দেখা যায়, ২০০ স্টলের মধ্যে প্রায় অর্ধেক স্টল খোলাই হয়নি। যারা খুলেছেন তাদের অনেকেই স্টল খোলা রেখে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যারা বসে আছেন তারা কাটাচ্ছেন অবসর সময়। তারা নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন কিংবা মোবাইল টিপছেন। আবার কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়েছেন। পাঠক দেখা গেছে হাতেগোনা দুয়েকটা স্টলের সামনে।
লিটলম্যাগ সংশ্লিষ্টরা জানান, লিটল ম্যাগের আগের সেই জৌলুশ আর নেই। কবি-লেখক ও পাঠকদের আড্ডা নেই, ক্রেতা নেই, দর্শনার্থীও নেই। পুরো সপ্তাহে ২-৫টা ম্যাগাজিন বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো স্টলে সেটিও হচ্ছে না। এখানে বসাকে সময়ের অপচয় ভাবছেন অনেকেই। মানুষ আর আগের মতো লিটল ম্যাগ পড়ে না। এছাড়াও মেলার আয়োজক কমিটির সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে দাবি করেন প্রকাশকরা।
পাঠক বাড়াতে মেলার এক কোণায় ঠেলে না দিয়ে পাঠক সমাগম হয় এমন জায়গায় লিটল ম্যাগের স্টল বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানান তারা।
লিটল ম্যাগাজিন কাব্য কথার বিক্রয় কর্মী রফিক মুহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, লিটল ম্যাগে একদমই বেচাকেনা নেই। কোনো দিন একটাও বিক্রি হয় না, আবার কোনো দিন ২-৩টা বিক্রি হয়। পুরো মেলায় এবার বিক্রি কম মনে হচ্ছে।
পাতাঘর সংসার ম্যাগাজিনের বিক্রয় কর্মী জুয়েল মিয়া বলেন, আজ এখনো বিক্রি হয়নি। বিক্রি খুব বেশি ভালো না, ১-২টা বিক্রি হচ্ছে। গড়ে সপ্তাহে ২-৪টা বিক্রি হচ্ছে। একপাশে হওয়ায় একদমই বিক্রি হয় না। আরেকটু ভালো জায়গায় রাখা উচিত ছিল।
লিটল ম্যাগ প্রাঙ্গণে কথা হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাবেক পরিচালক আবাম ছালাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, অনেকেই স্টলও খুলেনি, সবগুলো খুললে হয়তো বিক্রি হতো। একসময় লিটল ম্যাগ চত্বর জমজমাট ছিল। এখন আর তা নেই।
নিজেই পাঠকদের ডাকছেন, একটি বই কিনতে বলছেন কলমের কালি সম্পাদক সরকার জাহানারা ফরিদ। তিনি ২০১২ সাল থেকে লিটল ম্যাগে স্টল নেন। নিজের ও মেয়েদের বই রয়েছে স্টলে। পাঠকদের নিজের লেখা কবিতা শুনিয়েও বই বিক্রি করতে পারছেন না। জানতে চাইলে তিনি বলেন, লিটল ম্যাগ পেছনে পড়ে গেছে। ডেকোরেশন ভালো না। জায়গাটা ভালো না। ক্রেতা নেই একদমই। বসে লাভ নেই। আরেকটু ভালো জায়গায় থাকলে ভালো হতো।
এদিকে বইমেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শহীদ ইকবাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন হাফিজ রশিদ খান, অনিকেত শামীম এবং সরকার আশরাফ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাজ্জাদ আরেফিন।
প্রাবন্ধিক বলেন, লিটল ম্যাগাজিন একটা চিরনতুন প্লাটফর্ম। সময়ের সেবা না করে সময়কে সৃষ্টি করার চেষ্টা। এ সবই লিটল ম্যাগাজিনের মূল বৈশিষ্ট্য। লিটল ম্যাগাজিনের দিগ্বলয় চলিষ্ণু ও ক্রমবর্ধমান। এর ধারণা-বৈশিষ্ট্য কিংবা পন্থা ও পরিণাম অনতিক্রান্ত নয়, ক্রম বিকশিত ও পরিবর্তিত। আর তা নিশ্চয়ই এ দেশের মৃত্তিকা ও সংস্কৃতিকে অনুরুদ্ধ করেই পরিচালিত ও বিকিরিত। পরিচর্যায় পথটিও সে লক্ষ্যেই নির্ধারিত।
আলোচকরা বলেন, প্রচলিত ও গতানুগতিক সাহিত্যচর্চার বাইরে নতুন চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে যে পত্রিকা, সেটাই লিটল ম্যাগাজিন। নতুন ও তরুণ লেখকরাই লিটল ম্যাগাজিনের ধারক। প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে থেকে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার একটি মাধ্যম লিটল ম্যাগাজিন। আধুনিক ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার স্ফুরণ ঘটে এই পত্রিকায়। প্রচলিত ধারণাকে অস্বীকার করে নতুন কিছু বিনির্মাণ করতে চায় বলে লিটল ম্যাগাজিন সবসময়ই স্পর্ধিত এক চর্চার নাম।
সভাপতির বক্তব্যে সাজ্জাদ আরেফিন বলেন, সাহিত্য আন্দোলনকে বেগবান করতে প্রথাবিরোধী তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে লিটল ম্যাগাজিনের গৌরবকে সমুজ্জ্বল রাখতে হবে। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের গতিময়তা ফিরিয়ে আনার জন্য তরুণদের উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে।
এইচআর/এসএসএইচ/