অদিতি ফাল্গুনীর ‘ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে’
সন্ধ্যা বা রাতে ঘরের বাইরে বাজানোর বা গাওয়ার জন্য সুর বোধকরি ইংরেজিতে সেরেনাদ। সেরেনাদ ইতালিয়ান শব্দ সেরেনেটা ও লাতিন সেরেনাস থেকে এসেছে।
২০০০ সাল বা মিলিনিয়াম পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ইসলামী ছাত্রশিবিরের নৃশংসতা, জঙ্গিবাদের উত্থান, সাম্প্রদায়িক হামলা, ২০০৫ সালে ৬৪ জেলায় একযোগে বোমা হামলা, রমনা বটমূলে গ্রেনেড বিস্ফোরণ, ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচী সাংস্কৃতিক সংগঠনটির অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রগতিশীল শিক্ষক হত্যা, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি, শাহবাগের গনজাগরণ মঞ্চ, জঙ্গি নামধারীদের হাতে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া গনজাগরণ মঞ্চের সাথে জড়িত মানুষ, ইসলামের নাম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানবতায় নিবেদিত মানুষ কোপানো, ব্লগে লেখালেখি করা ভিন্নমত, মুসলিম অমুসলিম পীর পুরোহিত দেশি বিদেশি মানুষদের নির্মমভাবে একের পর এক হত্যার কাহিনি নিয়ে রচিত গল্প উপন্যাস নাটক সিনেমা শর্ট ফিল্ম বাংলাদেশে বিরল।
‘ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে’ অনেক দিনের অনেক মাসের পরিশ্রম, ধৈর্য, অনুসন্ধিৎসু স্পর্ধার যোগফল। শতাব্দীর ইতিহাস, নিকট অতীত, মানব সভ্যতার আলো-আঁধারের অজটিল পাঠযোগ্য দলিল, অসংখ্য চরিত্র এবং পার্শ্ব কাহিনি এই বইয়ের পাতায় পাতায় যেন কোলাজ ফরম্যাট।
একসময়, বাংলাদেশ বিরোধী একাত্তরের জামায়াতে ইসলামী, রাজাকার আলবদর আলশামসদের নেতৃত্ব প্রদানকারীদের বিচারের দাবি তোলে জনগণ, নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে ওয়াদাবদ্ধ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ইতিহাস, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে বিস্ময়ে হতবাক পৃথিবী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিদেশি চাপে মাথা নোয়াননি, একের পরে এক ঝুলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে আস্ফালনকারী খুনি ধর্ষক নেতৃত্ব।
আর এইসময়, বাংলাদেশের আকাশ হঠাৎ কালো অন্ধকারে ঢেকে যেতে থাকে, সপ্তাহ মাস বছর ধরে শুরু হয় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ, একা বা দলবদ্ধভাবে প্রাণ হারায় অনেক মানুষ, বিশেষ টার্গেট বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মানুষ আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
‘ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে’র এক প্রেক্ষাপটে আছে অসংখ্য কুপিয়ে পড়া নিহত গোলাপ, জুঁই ও তাদের স্বজনদের কথা, আছে হত্যাকারীও।
আছে যুক্তি, আছে সুর সংগীত, আছে বিজ্ঞান আর মানব কল্যাণ। আছে একই ধর্মে জাতপাত আবার কোথাও মতের বিভেদে সৃষ্ট আজন্ম লালিত ঘৃণা ও শত্রুতা যা আধুনিক যুগেও চলমান। আছে শোলাকিয়া, ইমামবাড়া, বাউল আর কীর্তন শিল্পীদের হাহাকার।
গুলশানে ক্যাফে হোলি আর্টিজান। আরেক প্রেক্ষাপটে বইয়ের পাতা, কোথাও কোথাও কয়েক শতাব্দীর দশকের ঘটনা বলা, বড় থিমগুলো ব্যাখ্যা করা।
বাংলার আধ্যাত্মিক ভাব-আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব সেই শ্রীচৈতন্যের মৃত্যু আজও এক ঘনীভূত রহস্য। আসলে ঠিক কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর?
এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আজও মেলেনি। অথচ চৈতন্যের মৃত্যু রহস্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে রহস্যজনকভাবে খুন হয়ে যান চৈতন্য গবেষক ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়।
সেই খুনেরও কোনো কিনারা হয়নি। রহস্য মীরাবাঈ ঘিরে, এসেছেন ইসলামের চার খলিফা, এরিস্টটল, আমাদের উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলার বীভৎস চিত্র ফিরে দেখা, বর্তমান ভারত সুইডেন, নিউজিল্যান্ডের উগ্রবাদীদের হাতে নিহত মানুষের মুখ, নামধাম, মৃতের কাফেলা।
শব্দ, বাক্যে প্রেক্ষাপট উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাসের কাঙ্ক্ষিত, যথাযথ, অভিনব, অভূতপূর্ব প্রয়োগ ইত্যাদির দিকে যাচ্ছি না, বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে সুপরিচিত প্রজ্ঞাবান কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কবি অদিতি ফাল্গুনী একটি বহুল পরিচিত নাম।
তার এই বই পড়া শেষ করে মনে হচ্ছে লেখক এই উপন্যাসের মাধ্যমে সময়কে জীবন দান করেছেন। যে সময়গুলো আমার মতো অনেকের চোখের সামনে হয়তো এখনো ভাসে, যে সময়গুলো মনে রাখার জন্য, ফিরে দেখার জন্য একদিন আবার ১৯৭১ আর ২০১৩ সালের সাংস্কৃতিক জাগরণে দিকে মানুষ ফিরবেই।
কারণ ‘একটা শক্তি ভেঙে ভেঙে অনেক হয়ে যায়। ...সত্য আর মিথ্যার মাঝখানে শক্তি কোনো সুতোর দাগ রাখে না। এক শক্তি প্রচণ্ড স্বার্থপর, হিসেবি, বিলক্ষণ সাবধানী; অন্য শক্তি অন্য রকম।’
২০২০ সালে ‘ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে’ বইটি প্রকাশ করেছে সংবেদ।
জাহান শ তিমির ।। লেখক