সাইবার নিরাপত্তা আইন বিষয়ে বিএফইউজের প্রস্তাব
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে সংশোধন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করেছে সরকার। সেই আইন পর্যবেক্ষণ করে সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে কয়েক দফা সুপারিশ ও প্রস্তাব জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)।
মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এক অনুষ্ঠানে বিএফইউজের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল এ সুপারিশ ও প্রস্তাব জানান। এসময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ সাংবাদিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন। প্রস্তাবটি হুবহু ঢাকা পোস্টের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
‘২০০৬ সনের আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অপব্যবহারের জ্বালায় যখন সাংবাদিক সমাজ অতিষ্ঠ তখন বলা হলো নতুন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ হচ্ছে, এতে ৫৭ ধারার বেদনার উপশম হবে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া দেখে আমরা উৎকণ্ঠিত হলাম। এতে ৫৭ ধারার উপশম তো হলোই না বরং তা’ আরও নতুন ব্যথা বাড়ালো। আমরা আলোচনায় সক্রিয় হলাম। সংসদীয় কমিটিতে পর্যন্ত কথা বললাম। কিন্তু আমাদের সাথে প্রতিশ্রুত বৈঠক শেষ না করেই সংসদে আইনটি পাস করা হলো। এখন নানা দেশ ও সংগঠনের যেসব কথার চাপে ডিজিটাল আইন ‘সংশোধন’ করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে, শুরুতে আমরা সেই কথা গুলোই বলেছিলাম। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়ে ২০১৮ সনের ১৮ সেপ্টেম্বর মহান জাতীয় সংসদে সে সময়কার তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছিলেন, আজকে আমি বলতে পারি যে, এই আইন পৃথিবীর অনেক দেশকে অনুসরণ করতে হবে...। সিঙ্গাপুরের মতো দেশ, যে দেশটিকে ধনী দেশ বলা হয়, সে দেশটির ডিজিটাল নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধি বিধান আইন কানুন- যদি দেখেন তাহলে প্র্যাক্টিক্যালি বুঝতে পারবেন যে, আমরা স্বর্গরাজ্য বানিয়েছি, আর ঐটিকে আপনি জেলখানা মনে করতে পারবেন ...।
মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এসে প্রমাণিত হলো, পৃথিবীর কোনো দেশ এই আইনতো অনুসরণ করেই নাই বরং সভ্য সমাজ বলছে, এই আইনের কারণে বাংলাদেশ স্বর্গরাজ্য হয়নি, জেলখানাই হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সময় আমাদের উদ্বেগ ছিল মূলত পাঁচটি জায়গায়—
১. জামিন অযোগ্য ধারা অনেক বেশি, কোথাও শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ অস্বাভাবিক
২. কোন কোন ধারায় অপরাধের সংজ্ঞা অস্পষ্ট
৩. আইনটিতে পুলিশের যে পর্যায়ে অবারিত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে অপপ্রয়োগের মাত্রা বাড়বে
৪. বিশেষত: সংবাদকর্মীদের বেলায় এই আইনের বেপরোয়া প্রয়োগের কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে
৫. এর সাথে আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম: প্রচলিত ফৌজদারি আইনে যে সব অপরাধ ও তার সাজা বিধান নিশ্চিত আছে সেগুলো এই আইনে কেন আনা হচ্ছে? তথ্য অধিকার আইনে আমাদের যে এগিয়ে যাওয়া, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এনে তাকে কেন বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে ?
বলাই বাহুল্য, আমাদের এসব কোন কথাই শোনা হলো না, বরং আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের নানা ধারায় ছড়িয়ে দেয়া হলো। আখেরে আমাদের কথাই সত্য হলো। পাঁচ বছরে হাজার হাজার মামলায় হয়রানি হলেন অনেকে, এত মামলার মধ্যে টিকলো অল্পসংখ্যক মামলা, আটক হলেন কয়েক ডজন সাংবাদিক। কাজেই অনেক ক্ষেত্রেই হয়রানির জন্য এই আইনের প্রয়োগ করা হয়েছে তা খুবই স্পষ্ট।
এত মূল্যের বিনিময়ে যে বোধোদয় তাকে স্বাগত জানাই। স্পষ্ট করেই বলি: সাইবার অপরাধ দমনের জন্য আমরা সাইবার নিরাপত্তা আইন চাই। কিন্তু তা যেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার যে সাংবিধানিক সুরক্ষা তাকে বিপন্ন না করে।
সাইবার সিকিউরিটি আইনের খসড়া দেখেছি। সংশোধিত আইনে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কিছু ধারায় জামিনের সুযোগ বাড়লো বটে, কিন্তু কিছু ধারায় অস্বাভাবিক জরিমানার বিধান করা হলো। সেই জরিমানা দিতে না পারলে জেলে যাওয়ার খড়গ মাথার ওপর ঝুলেই থাকলো। বলা হচ্ছে, ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও বিচারক এক টাকাও জরিমানা করতে পারেন। কথা সত্য। তাহলে বিশাল অংকের জরিমানা রাখা হলো কেন? ভয় দেখানোর জন্য? বাকি ধারাগুলোতেও খুব বড় পরিবর্তন দেখছি না।
প্রস্তাবিত সিকিউরিটি আইনটি ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আনতে কয়েকটি সুপারিশ করতে চাই—
১. ফৌজদারি আইনে যে সকল অপরাধ ও সাজা নির্ধারণ করা আছে এই আইনে তা সংযোজন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না ।
২. এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করে দুইশ' বছরেরও বেশি পুরনো অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টকে নতুন করে জীবন দেয়ার কোন মানে হয় না। আমরা এর বিরোধিতা করি।
৩. আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪২ ধারায় অপরাধের সংজ্ঞা ও এই আইনের প্রয়োগ প্রক্রিয়া আরও সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন।
বিবেচনার জন্য আমাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি—
ক. ৮ নম্বর ধারায় উপধারা ২: যদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট প্রতীয়মান হয়.... ‘প্রতীয়মান’ শব্দটি বিপজ্জনক। আইনি প্রক্রিয়ায় কোনো অভিযোগ প্রাপ্তি, তদন্ত বা প্রমাণের আগেই শুধু ‘প্রতীয়মান’ হওয়ার ভিত্তিতে অবারিত ক্ষমতার প্রয়োগ রাখার বিধান বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
খ. ২১ নম্বর ধারা: মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণার দণ্ড। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি সংজ্ঞায় স্পষ্টীকরণ করা হয়েছে। জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালানো হবে অপরাধ। এইসব অভিযোগ এবং এ সবের প্রতি সমর্থনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকতে হবে।
গ. ২৫ নম্বর ধারা: আক্রমণাত্মক, মিথ্যা ও ভীতি প্রদর্শক, তথ্য উপাত্ত প্রেরণ প্রকাশ ইত্যাদি। আরও সুনির্দিষ্ট করা দরকার বা এই ধারাটি বাতিল করা দরকার। রাজনৈতিক বক্তৃতা তো আক্রমণাত্মক হয়, কোনো মালিক বেতন ভাতা না দিলে তার অফিস ঘেরাও করে ভুক্তভোগী শ্রমিক কর্মচারীরা যে আন্দোলন করে সেখানে এইসব উপাদান-তো থাকবেই। এ সবই কি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে ?
ঘ. ধারা ২৮: ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত প্রসঙ্গ। এটা আরও সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। ধরা যাক, দুই পীরের বা মাজারের সমর্থক দুই গ্রুপ পরস্পরের পীর বা বিশ্বাসের প্রতি আক্রমণ করে বক্তব্য দিলো, এটি নিয়ে অভিযোগ আনা হলে এই বিতর্কের অবসান হবে কিভাবে? যেমন হিন্দুধর্ম সংস্কার নিয়ে একপক্ষ কাজ করছে, প্রকাশ্যেই আলোচনা চলছে আবার অপরপক্ষ মনে করে এটা সনাতন ধর্মের প্রতি আঘাত। এই নিয়ে কোন মামলা কি এই আইনের আওতায় আসবে?
ঙ. ধারা ২৯: মানহানিকর তথ্য প্রকাশ: এই বিষয়ে penal Code (Act XLV of 1860 ) এর section 499 এ যেহেতু স্পষ্টীকরন করা আছে, সেহেতু এই ধারাটি নতুন করে সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না ।
চ. ৩১ ধারা: আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো : এই ধারাটি এতই ব্যাপক যে রাজনীতি ও পেশাজীবী আন্দোলনের যে কোন কর্মসূচি পালনের পর যে কাউকে এই ধারায় অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে। ঘটনা ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, বিষয়টি এতটা অস্পষ্ট এবং প্রয়োগের ক্ষমতা এতটা ব্যাপক যে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করবে।
চ. ৩২ ধারা: অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনকে নতুন জীবন দেয়ার বিরুদ্ধে আমরা। এই ধারা পুরোটা বাতিলের দাবি জানাচ্ছে সাংবাদিক সমাজ।
ছ: ধারা ৪২ পরোয়না ব্যতিরেকে তল্লাশী, জব্দ ও গ্রেপ্তার : এই ধারায় সাব ইনস্পেক্টরের 'নিচে নহেন' এমন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তাকে পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জন্ম ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই রাখা হয়েছে। এটিই হচ্ছে আইনটির 'মিস ইউজ ও এ্যাবিউজ'র মূল শক্তি। এই ধারাটি অক্ষুন্ন রেখে আইন অপব্যবহার হবে না বিষয়টি কোনভাবেই নিশ্চিত করা যাবে না। সংবাদকর্মীরা এর খপ্পড়ে আগেও যেমন পড়েছেন, এবারও রেহাই মিলবে না। আমাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব, সাংবাদিকদের বেলায় এই ধারা রহিত করতে হবে। কোনভাবেই এই ধারায় সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীকে পেশাগত কোনো কাজের জন্য গ্রেপ্তার করা যাবে না। কোনো সাংবাদিকের কোনো কাজে আপত্তি থাকলে সমন জারি করে আদালতে হাজির হতে বলা যাবে। সাংবাদিকের নামে কোনো মামলা করার গ্রহণযোগ্যতা (প্রাইমা ফেসি) যাচাইয়ের জন্য প্রেস কাউন্সিলের মতামত নিতে হবে ।
এই পর্যালোচনার পাশাপাশি আমাদের প্রস্তাব—
খসড়া আইনের কোনো ধারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় সংবিধানের বিধান, তথ্য অধিকার আইন-২০১৯ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় কি না তা আরও নিবিড়ভাবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ‘মিস ইউজ ও এবিউজ হয়েছে এটা আইনমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন। অনেককে শুধু হয়রানি করার জন্যই মামলা করা হয়েছে। সাইবার সিকিউরিটি আইন যাতে সেই একই পথে না হাঁটে সেজন্য এই আইনে কয়েকটি ধারা বা উপধারা সংযোজন করার বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ জানাচ্ছি
১. এই আইনে কেউ মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা করলে তার (বাদীর) বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকতে হবে।
২. খসড়া আইনে ‘জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সী’ গঠনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে একজন সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম বিশেষজ্ঞ রাখার প্রস্তাব রাখছি। এতে আইনটি প্রয়োগের শুরুতেই অনেক ঝামেলা এড়ানো যাবে।
৩. জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিলে বিএফইউজে'র সুপারিশ অনুযায়ী একজন সাংবাদিক বা গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ রাখার প্রস্তাব করছি।
পৃথিবী পাল্টাচ্ছে, অপরাধের ধরনও বদলাচ্ছে। সাইবার জগত যেমন আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার অবারিত দুয়ার, তেমনি এই জগত অপরাধীদের জন্যও উন্মুক্ত করেছে অপরাধের নানা ক্ষেত্র ও কৌশল। কাজেই সাইবার জগত থেকে চোখ মুদে থাকার কোন অবকাশ নেই। ইউরোপ আমেরিকার প্রায় সব দেশেই নানা নামে সাইবার নিরাপত্তা আইন আছে। বাংলাদেশে সাইবার নিরাপত্তায় আইন করা সময়ের দাবি। খেয়াল রাখতে হবে, সেই আইন দেশকে স্বর্গরাজ্য না বানাক, জেল খানা যাতে না বানায়। এটাই সাংবাদিক সমাজের প্রত্যাশা।
/এমএইচএন/এমএ