জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রে রাখার তাগাদা

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে টেকসই নগর উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা অনুশীলন প্রয়োজন। এমন মতই উঠে এসেছে একটি আলোচনা থেকে।
আলোচকরা মনে করছেন, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে টেকসই নগর পরিকল্পনা প্রণয়নসহ, স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়ন, বিল্ডিং কোড ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সুষ্ঠু প্রয়োগ, জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ, গণপরিবহণ কাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সমতা বিধানের মাধ্যমে কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থসেবা প্রদান, কঠিন ও পয়ঃবর্জ্য পরিকল্পনা তথা টেকসই উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা অনুশীলন প্রয়োজন।
আজ (মঙ্গলবার) সাসটেইনেবল ফান্ডিং ফর হেলথ প্রোমশন শীর্ষক দুইদিনব্যাপী অনলাইন কনফারেন্সে দ্বিতীয় দিনে ‘আরবান প্ল্যানিং এন্ড হেলথ প্রমোশন’ শীর্ষক সেমিনারে আলোচকরা এসব কথা বলেন। সেমিনারটির আয়োজন করে ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স, থাই হেলথ, হেলথ ব্রিজ অব কানাডা এবং বাংলাদেশ অ্যান্টি টোবাকো অ্যালায়েন্স।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদের সভাপতিত্বে এবং সঞ্চালনায় প্ল্যানারি সেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান। এছাড়াও প্ল্যানারি সেশনে অতিথি বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএন-হ্যাবিটেটের আরবান ডেভলপমেন্ট স্পেশালিস্ট পরিকল্পনাবিদ মো. সোহেল রানা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. মো. শাকিল আক্তার এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের (এনআইএমএইচ) শিশু-কিশোর এবং পারিবারিক মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দীন আহমেদ।
প্ল্যানারি সেশনের শুরুতে ড. আদিল মুহাম্মদ খান ‘জনস্বাস্থ্যের জন্য নগর পরিকল্পনা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, নগর পরিকল্পনার উদ্ভব হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ে কারণে। তাই জনস্বাস্থ্যের সাথে নগর পরিকল্পনা ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্কযুক্ত। এছাড়াও জনস্বাস্থ্য কেবল স্বাস্থ্যগত ধারণা কিংবা শুধুমাত্র স্বাস্থ্য অবকাঠামোর সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়, শহরের সার্বিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার সাথেও সরাসরি যুক্ত।
ড. আদিল জনস্বাস্থ্যের সাথে নগর পরিকল্পনার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তায় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন, এলাকাভিত্তিক খেলার মাঠ, পার্ক, জলাশয় ও উদ্যানের ব্যবস্থা করাসহ মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতকল্পে সামাজিকায়নের ব্যবস্থা করা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত রোগ-ব্যাধি থেকে সুরক্ষা প্রদানে কঠিন ও পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশন পরিকল্পনা করা, এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যকে বিবেচনায় রেখে সকলের আর্থিক সক্ষমতা অনুযায়ী সাশ্রয়ী আবাসন নিশ্চিত করা, পরিবেশ দূষণের সাথে সম্পর্কিত রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষায় সুষ্ঠু এবং টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্মল পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে উন্নত করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে জনস্বাস্থ্যকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
মো. সোহেল রানা নগর পরিকল্পনার সাথে যে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সে বিষয়ে আলোকপাত করে পাঁচটি পয়েন্ট তুলে ধরে বলেন, সামাজিকভাবে এমন শহর গড়ে তুলতে হবে যেখানে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। এছাড়াও স্বাস্থ্য খাতকে উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নয়নসহ উন্মুক্ত গণপরিসর, ফুটপাত, জলাশয়, সবুজ বনায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং একইসাথে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. মো. শাকিল আক্তার বলেন, নগর পরিকল্পনা বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের সাথে একটি পরিকল্পিত নগরের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, যান্ত্রিক যানবাহনের ওপর আমাদের নির্ভরতা কমাতে হবে। এছাড়াও পরিবেশ দূষণ রোধে পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেন এবং নগর ও জনপদের উন্নয়নে নীতি নির্ধারকদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের (এনআইএমএইচ) শিশু-কিশোর এবং পারিবারিক মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দীন আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে নগরের প্রত্যেক উপাদান জড়িত। মানসিক চাপ কমাতে ‘গ্রিন থেরাপি’ এর গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশে সবুজায়নের বিকল্প নেই। একটি মানুষ ১৮ মিনিট সবুজ গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকলে তার মানসিক চাপ কমে যায়। এছাড়াও তিনি মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে এবং শিশুবান্ধব নগর গড়ে তুলতে টেকসই নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ সভাপতির বক্তব্যে বলেন, স্বাস্থ্যখাত শুধু ওষুধ আর চিকিৎসালয় নয়, স্বাস্থ্যখাতের সাথে নগর পরিকল্পনার প্রত্যেক উপাদান জড়িত। স্বাস্থ্যখাতকে শুধু তত্ত্বীয় পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনায় না নিয়ে প্রতিরোধ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনায় রেখে নগর পরিকল্পনা করতে হবে যাতে নগর এবং গ্রামীণ জনবসতিরও সুস্থ জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায়।
এএসএস/এনএফ