স্বামী মারার অধিকার রাখে, মনে করে এক তৃতীয়াংশ বিবাহিত কিশোরী

দেশের ৯৮ শতাংশ কিশোরী ঋতুকালে একবার ব্যবহারযোগ্য প্যাড সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে বহুবার ব্যবহার করে বলে এক জরিপে উঠে এসেছে। এমনকি তাদের অধিকাংশই ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার আগে বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন সম্পর্কে জানে না। এসব তথ্যের জন্য তারা বইয়ের ওপর নির্ভর করলেও তথ্যসংগ্রহের মূল মাধ্যম হলো অনলাইন। এছাড়া এক-তৃতীয়াংশ (৩৪ শতাংশ) বিবাহিত কিশোরী মনে করে, স্ত্রী কথা না শুনলে স্বামী তাকে শারীরিকভাবে আঘাতের অধিকার রাখে।
বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘বাংলাদেশ এডোলেসেন্ট হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং সার্ভে ২০১৯-২০’ জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। দেশব্যাপী এই জরিপ পরিচালনা করেছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (নিপোর্ট)। এতে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে আইসিডিডিআর,বি-এর রিসার্চ ফর ডিসিশন মেকার্স (আরডিএম) প্রকল্প এবং ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনার ডাটা ফর ইমপ্যাক্ট (ডিফরআই)।
জরিপের মূল প্রতিবেদনে কিশোর-কিশোরীদের গণমাধ্যম ব্যবহার, বিয়ে, ঋতুকালীন স্বাস্থ্যবিধি, জেন্ডার (লিঙ্গ) সম্পর্কিত সামাজিক আচরণ, সহিংসতা, মানসিক স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও খাদ্যবৈচিত্র্য এবং পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সংযোগ বিষয়ক ১২টি অধ্যায়ে জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে।
জরিপে দেখা যায়, ৭৩ শতাংশ অবিবাহিত কিশোরী এবং ৬৬ শতাংশ অবিবাহিত কিশোর বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। তাদের মধ্যে প্রতি চার জনের একজন কিশোরী (বিবাহিত এবং অবিবাহিত) ঋতুর সময়ে কমপক্ষে এক দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ রাখে। তবে, ঋতুকালীন স্বাস্থ্যকর আচরণের প্রবণতা এখনও বেশ কম, বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে ৯ শতাংশ এবং অবিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে ১২ শতাংশ মাত্র।
জরিপ অনুসারে, প্রতি ১০ অবিবাহিত কিশোরর-কিশোরীর মধ্যে এক জন কৃশকায় বা কম ওজনের, এবং অন্য ১০ শতাংশের এক ভাগ স্থূলকায় বা বেশি ওজনের। এতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ৭৬-৮৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরীরা খাদ্যের পাঁচটি গ্রুপ যেমন শাকসবজি, স্টার্চ জাতীয় খাবার, দুগ্ধ, প্রোটিন এবং ফ্যাটযুক্ত খাবারের মধ্যে চারটি গ্রুপেরও বেশি খাবার গ্রহণ করে থাকে যা শরীর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেশিরভাগ কিশোর-কিশোরী (৭০-৮০ শতাংশ) আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করে। তবে, মাত্র এক চতুর্থাংশ কিশোর-কিশোরী ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বিয়ে হয়েছে এমন কিশোরীদের ৯৭ শতাংশ যারা এখনও স্বামীর সঙ্গে আছে এবং তিন শতাংশ কিশোরীর বিচ্ছেদ হয়ে পৃথক আছে অথবা বিধবা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৭ শতাংশ বর্তমানে চার বছর বা অধিক সময় ধরে বিবাহিত, এসব কিশোরীদের ৩০ শতাংশের স্বামীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য কমপক্ষে ১০ বছর। সর্বোচ্চ সংখ্যক কিশোরী (৪৫ শতাংশ) যাদের স্বামীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য ১০ বছর বা তার বেশি, তারা আর্থিকভাবে সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক-তৃতীয়াংশ (৩৪ শতাংশ) বিবাহিত কিশোরী এবং প্রায় এক-পঞ্চমাংশ (১৮ শতাংশ) অবিবাহিত কিশোরী মনে করে, স্ত্রী কথা না শুনলে স্বামী তাকে শারীরিকভাবে আঘাতের অধিকার রাখে। ৮৮ শতাংশ অবিবাহিত কিশোরী পথে এবং ১৯ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময় যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
৭২ হাজার ৮০০ পরিবারকে জরিপের নমুনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৬৭ হাজার ৯৩টি পরিবারে সফলভাবে জরিপ পরিচালনা করা হয়। মোট চার হাজার ৯২৬ জন বিবাহিত কিশোরী (৯৭ শতাংশ সাড়া প্রদান হার), সাত হাজার ৮০০ অবিবাহিত কিশোরী (৯৪ শতাংশ সাড়া প্রদান হার) এবং পাঁচ হাজার ৫২৩ অবিবাহিত কিশোরের (৮৫ শতাংশ সাড়া প্রদান হার) এই জরিপের আওতায় সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
জরিপের তথ্য সংগ্রহের মান নিশ্চিত করতে আইসিডিডিআর,বি ১৮ জন কর্মকর্তা এবং চারটি মান নিয়ন্ত্রণ টিমের মাধ্যমে তথ্যসংগ্রহ, পরিবার ও ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের সময় তারা নির্দেশনা দেন।
জরিপে আরও উঠে এসেছে, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচটি পরিবারের একটিতে কমপক্ষে একজন কিশোর/কিশোরী (১৫-১৯ বছর বয়সী) আছে। কিশোর-কিশোরীর মধ্যে ৯৭ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় (স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা) অংশগ্রহণ করেছে। দেশের ৯০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মোবাইলফোন ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে। বিবাহিত কিশোরীদের প্রায় অর্ধেক ও অবিবাহিত কিশোরীর প্রায় এক-চতুর্থাংশের নিজস্ব মোবাইলফোন আছে। কিশোরদের ৫০ শতাংশ এবং বিবাহিত এবং অবিবাহিত কিশোরীদের ২০ শতাংশ সপ্তাহে কমপক্ষে একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন- স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সচিব মো. আব্দুল মান্নান, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের সচিব মোহাম্মাদ আলী নূর, মার্কিন দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি-এর পপুলেশন হেলথ নিউট্রিশন অ্যান্ড এডুকেশন অফিসের পরিচালক জার্সেস সিধওয়া।
জার্সেস সিধওয়া তার বক্তব্যে বলেন, ‘জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে কিশোর-কিশোরীরা তাদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে আরও তথ্য চায়। এখন আমাদের ভাবতে হবে এই কিশোর-কিশোরীদের আমরা কতটা কার্যকরীভাবে এসব তথ্য দিতে পারি। আর এ জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন সেক্টরের একীভূত পদক্ষেপ।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এর অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ন্যাশনাল স্ট্রাটেজি ফর এডোলেসেন্ট হেলথ ২০১৭-৩০ তৈরি ও বাস্তবায়ন করছে। স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ এসব উন্নতি সাধন করলেও বাল্যবিবাহ, কৈশোরে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণের হার এখনও বেশি।’
‘স্বাস্থ্যখাতে অর্জিত উন্নয়ন সমুন্নত রাখতে বাল্যবিবাহ রোধকরা, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক’, বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
টিআই/এফআর