কে হচ্ছেন দুদকের নতুন অভিভাবক

দুর্নীতি দমন ও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু হয় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে কমিশনের জন্ম হওয়ার পর ১৭ বছর পেরিয়েছে। এরমধ্যে কমিশন গঠন ও পুনর্গঠিত হয়েছে পাঁচবার। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বে কমিশন পুনর্গঠিত হয়েছিল।
সে হিসেবে আগামী মার্চে শেষ হচ্ছে বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার এএফএম আমিনুল ইসলামের কার্যকাল। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের স্থলে নতুন দুই জনকে নিয়োগ দিতে হবে। সে লক্ষ্যে গত ২৮ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি বা সার্চ কমিটি গঠন করেছে সরকার। ইতোমধ্যে কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাদের প্রস্তাবিত নামগুলো থেকে রাষ্ট্রপতি দুই জনকে চূড়ান্ত নিয়োগ দেবেন।
বাছাই কমিটির কার্যক্রমের মধ্যেই দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার হিসেবে ‘নিয়োগযোগ্য’ কিছু নাম ‘হাওয়ায়’ ভাসছে। সংস্থাটির নতুন অভিভাবক নিয়োগ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। কে হচ্ছেন দুদকের নতুন চেয়ারম্যান? সামনের কমিশন দুর্নীতি দমনে কতটুকু অবদান রাখতে পারবে কিংবা রাঘব-বোয়ালরা কতুটুক নিরাপদ? এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে। একেক উৎস থেকে এক একটি নাম বেরিয়ে আসছে। চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন রাষ্ট্রপতি।
যাদের নাম আলোচিত হচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভুঁইয়া, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সাবেক আইন সচিব কাজী হাবিবুল আওয়াল, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারী, অবসরপ্রাপ্ত বেসামরিক বিমান সচিব মহিবুল হক, অবসরপ্রাপ্ত সচিব এম এ করিম ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সচিব ড. এম আসলাম আলম।
তাদের মধ্যে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভুঁইয়া, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, সাবেক আইন সচিব কাজী হাবিবুল আওয়ালের নাম চেয়ারম্যান হিসেবে বেশি আলোচিত হচ্ছে।
নাজমুন আরা সুলতানা হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের প্রথম নারী বিচারপতি ছিলেন। ১৯৫০ সালে মৌলভীবাজারে জন্ম নেওয়া নাজমুন আরা সুলতানা ১৯৭৫ সালে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিচারবিভাগে যোগদান করেন। তিনি বাংলাদেশে প্রথম নারী মুনসিফও (সহকারী জজ) বটে। আলোচিতদের মধ্যে তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ।
আলোচনায় থাকা সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভুঁইয়া ১৯৫৭ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। সেনাপ্রধান হিসেবে ২০১২ সালের ২৫ জুন দায়িত্ব নিয়ে ২০১৫ সালের ২৫ জুনে অবসরে যান তিনি।
দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে আলোচিতদের মধ্যে আরও আছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান। ১৯৬০ সালে সুনামগঞ্জে জন্ম নেওয়া নজিবুর রহমান মুখ্য সচিব ছাড়াও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আলোচনায় থাকা সাবেক সিনিয়র সচিব আবুল কালাম আজাদ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করেন। তিনি বিসিএস ৮১ ব্যাচের কর্মকর্তা।
আলোচনায় থাকা সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আওয়াল বিভিন্ন মেয়াদে আইন মন্ত্রণালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয় ও প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
চাঁদপুরে জন্ম নেওয়া পুলিশের সাবেক আইজি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীও আছেন আলোচনায়। দুদক কমিশনার হিসেবে তার নামই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খানের নামও চেয়ারম্যান হিসাবে বেশ আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে তার নাম বেশি শোনা যাচ্ছে।
বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের সমন্বয়ে গঠিত প্রথম কমিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর। এরপর যথাক্রমে সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধুরী, গোলাম রহমান ও মো. বদিউজ্জামানের পরে ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ দায়িত্ব নেন বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।
দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে দুদক আইন-২০০৪ এর ৫(১) ধারায় বলা আছে, কমিশন তিন জন কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত হবে এবং তাদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি এক জনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করবেন। সংস্থাটির চেয়ারম্যানের মর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা আপিল বিভাগের বিচারপতির সমান। দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুদক। স্বশাসিত স্বাধীন এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পদে কে নিয়োগ পাচ্ছেন? এ প্রশ্ন তাই এখন অনেকটাই প্রাসঙ্গিক।
অন্যদিকে দুদক আইনে কমিশনার পদে নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। আইনের ৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, আইনে, শিক্ষায়, প্রশাসনে, বিচারে বা শৃঙ্খলাবাহিনীতে অন্যূন ২০ (বিশ) বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি কমিশনার হওয়ার যোগ্য হবেন।
আর অযোগ্যতার প্রশ্নে ৮(২) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিক না হওয়া, কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ খেলাপি হিসেবে ঘোষিত বা চিহ্নিত, আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দেউলিয়াত্বের দায় থেকে অব্যাহতি লাভ না করা, নৈতিক স্খলন বা দুর্নীতিজনিত কোনো অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে আদালতে কারাদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তি, সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থাকা, দৈহিক বা মানসিক বৈকল্যের কারণে কমিশনের দায়িত্ব পালনে অক্ষম, বিভাগীয় মামলায় গুরুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি। আইনে বেঁধে দেওয়া এ যোগ্যতা-অযোগ্যতার নিরিখে বাছাই কমিটি সুপারিশ করবে যোগ্য কমিশনারদের নাম।
দুদক আইন অনুযায়ী, প্রথমে চার বছর মেয়াদে চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের দায়িত্ব থাকলেও পরে ২০১৩ সালের নভেম্বরে তা সংশোধন করে পাঁচ বছর করা হয়। আইনের ৬(৩) ধারায় মেয়াদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কমিশনারগণ, ধারা ১০-এর বিধান সাপেক্ষে, তাহাদের যোগদানের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর মেয়াদের জন্য স্ব-স্ব পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন’।
বাছাই কমিটির বিধি অনুসারে কমিটির একেক জন সদস্য একেকটি পদের বিপরীতে দুজনের নাম প্রস্তাব করতে পারবেন। পরে সেখান থেকে বাছাই কমিটি একেকটি পদের বিপরীতে রাষ্ট্রপতির কাছে দুজনের নাম প্রস্তাব করবেন। আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত বাছাই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এবং মন্ত্রিপরিষদের অবসরপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন ভুঁইয়া।
বাছাই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি দুই পদে নিয়োগ দেবেন। নিয়োগ পাওয়া কমিশনারদের মধ্য থেকেই এক জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে দুদক চেয়ারম্যান পদে। মূলত সাধারণ মানুষসহ সংশ্লিষ্টদের আগ্রহের জায়গা ওই পদকে ঘিরেই। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটবে নিয়োগপত্রে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে।
আরএম/এসএসএইচ
