ধানভিত্তিক ঐতিহ্য কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে ব্রি রাইস মিউজিয়াম

পথের কেনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সঙ্কেত,
সবুজে হদুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের ক্ষেত।
ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে,
ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়ে পাখিগুলে শুয়েছে মাঠের পরে।
-ধান ক্ষেত, কবি জসিম উদ্দিন।
হ্যাঁ, ধান নিয়ে গ্রামবাংলায় কবি সাহিত্যিকরা এমন আবেগঘন কতশত কবিতা রচনা করেছেন তার অন্ত নেই। কেননা, ধান এদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা মানে আমরা ধান বা চালের নিরাপত্তা কে বুঝি। হেনরি কেসিঞ্জারের অবজ্ঞার সে তলাবিহীন ঝুড়ি এখন উপচেপড়া উদ্বৃত্ত খাদ্যের সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকে ধাননির্ভর সমাজ ও সংস্কৃতিতে এসেছে অনেক পরিবর্তন, ধানভিত্তিক অর্থনীতিতে ঘটেছে নানা রূপান্তর। গরু দিয়ে হাল চাষ, মই চাষ আর ধান মলনের দৃশ্য গ্রামবাংলায় অদৃশ্য হতে চলেছে। সেখানে এসেছে কলের লাঙ্গল, অত্যাধুনিক বপন ও রোপন যন্ত্র। সনাতন জাতের ক্ষেত্রে এসেছে উচ্চফলনশীল আধুনিক জাত। আগাছা দমন ও বালাইনাশক স্প্রে কিংবা পাকা ধান কর্তন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সব কিছুতেই লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। তাই বলে কি দেশীয় ধানভিত্তিক জাত, কৃষ্টি কালচার হারিয়ে যাবে?
না সেটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। দেশের ধান গবেষণার ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধানভিত্তিক কৃষ্টি ও কালচার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠা করেছে দেশের প্রথম রাইস মিউজিয়াম।
এ মিউজিয়ামে ধানের বীজ থেকে বীজ বৃদ্ধি পর্যায়, গত পাঁচ দশকে ব্রি উদ্ভাবিত বিভিন্ন উফশী জাতের ধান ও চালের নমুনা, দেশীয় বিভিন্ন আদি জাত, চালের তৈরি পিঠাপুলি, ধানের উপজাত পণ্যগুলো, প্রধান প্রধান আগাছা, রোগবালাইয়ের সচিত্র নমুনা, ধান চাষে ব্যবহৃত দেশীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির রেপ্লিকা, ধানভিত্তিক কৃষ্টি ও কালচারের রেপ্লিকা এবং ধান নিয়ে লেখা দেশি-বিদেশি বইপত্র এক ছাদের নিচে এনে প্রদর্শন করা হচ্ছে।
খাদ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশের সাফল্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে সুন্দর ও ফলপ্রসূভাবে তুলে ধরার জন্য এই প্রথম এমন একটি অত্যাধুনিক রাইস মিউজিয়াম স্থাপন করা হলো।

ব্রিতে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও দেশি-বিদেশি পর্যটক এবং গবেষণকরা আসেন। তাদের কাছে দেশের ধানভিত্তিক অর্থনীতির বিবর্তনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, এই খাতের অর্জন ও সাফল্য তুলে ধরাই এই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য বলে জানান উদ্যোক্তরা। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এ মিউজিয়ামে এসে ধান চাষাবাদের প্রতিটি বৃদ্ধি পর্যায় সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাবেন। সেখানে দেশে উদ্ভাবিত বিভিন্ন ধানের জাত এবং এর সেদ্ধ ও আতপ চালের নমুনা যেমন এখানে আছে, দেশী জাতের বৈচিত্র্যময় ধান ও চালের নমুনাও তারা একছাদের নীচে দেখতে পারছেন।
রাইস মিউজিয়ামটিতে সনাতন সময়ের ধানচাষ থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত ধান রোপন, মাড়াই ও কর্তন সময় পর্যন্ত যে সব পৌরণিক ও আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করা হতো বা হচ্ছে তা প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে।
২০১৮ সালে এ রাইস মিউজিয়াম স্থাপনের কাজ শুরু করা হলেও এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় চলতি বছরের ১২ মার্চ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক ড. কিউ ডুঙ্গার ব্রি সফর উপলক্ষ্যে এটি প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত করা হয়।
প্রসঙ্গত এটিই বাংলাদেশের একমাত্র ও প্রথম রাইস মিউজিয়াম। কেননা এর আগে এই ধরনের কোনো মিউজিয়াম দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে ছিল না। মিউজিয়ামটি স্থাপনে সরকারি রাজস্ব খাতের পাশাপাশি অর্থায়ন করেছে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ)।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র লিয়াজোঁ অফিসার এবং ব্রি রাইস মিউজিয়াম কর্মসূচির পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মোমিন জানান, আন্তর্জাতিক মানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রিতে একটি সুসজ্জিত রাইস মিউজিয়ামের অভাব ছিল। তাই এই দেশের ধান গবেষণার অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধানভিত্তিক আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি এবং খাদ্য নিরাপত্তায় ব্রি তথা বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে সুন্দর তুলে ধরার জন্য একটি অত্যাধুনিক রাইস মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়েছে।

রাইস মিউজিয়ামে ধান রোপন থেকে চাল হিসেবে কৃষকের ঘরে তোলা পর্যন্ত সকল প্রক্রিয়া ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে ব্রি উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তি প্রদর্শনীর জন্য ১৫টি সেলফ স্থাপন করা হয়েছে। জাত ও প্রযুক্তিগুলোর নমুনা ও রেপ্লিকা স্থাপন করা হয়েছে। মিউজিয়ামে ডিসপ্লে সেলফে নতুন ও পুরনো কৃষি যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। যা দেখে দেশি-বিদেশি পরিদর্শকরা উদ্বুদ্ধ হবেন।
বাংলাদশ ধান গবেষণা ইনস্টিউটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান জানান, প্রতি বছর অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক, বিভিন্ন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকরা ব্রি পরিদর্শনে আসেন। তারা খাদ্য নিরাপত্তায় ব্রির অগ্রগতির ইতিহাস ও সার্বিক কর্মকাণ্ড এক নজরে দেখতে চান। আন্তর্জাতিক মানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ব্রিতে ইতোপূর্বে কোনো সুসজ্জিত রাইস মিউজিয়াম ছিল না। ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ব্রি পরিদর্শনে এসে হতাশ হতেন। তাই দেশের ধান গবেষণার অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধানভিত্তিক আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি এবং খাদ্য নিরাপত্তায় ব্রি তথা বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে সুন্দর ও ফলপ্রসুভাবে তুলে ধরার জন্য ব্রিতে একটি অত্যাধুনিক রাইস মিউজিয়াম স্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদশ ধান গবেষণা ইনস্টিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ধানকে এদেশের জাতীয় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খাদ্য নিরাপত্তা বলতে এদেশে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ভাতের নিরাপত্তাকেই বোঝানো হয়। কোনো দেশের শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি কিংবা রাজনীতি সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় খাদ্য নিরাপত্তা দিয়ে। বিশ্বমানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর থেকে গত সাড়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে ব্রি এদেশের ক্রমর্বধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। ব্রি গত পাঁচ দশকে বন্যা, খরা ও লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধান, শীত প্রধান অঞ্চলের উপযোগী ধান, সরু ও সুগন্ধি প্রিমিয়াম কোয়ালিটি ধান, জিংক সমৃদ্ধ ধান (বিশ্বের প্রথম) ও হাইব্রিড ধানসহ গত ১০১টি ইনব্রিড ও ৭টি হাইব্রিড মিলিয়ে মোট ১০৮টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। যার সবগুলোর নমুনা এই মিউজিয়ামে প্রদর্শন করা হচ্ছে।
এনএফ
