নীরবে-নিভৃতে বাবাকে এখনও খুঁজে বেড়ায় সাদাকাত

সাদাকাত সাবরির মমিন। জন্মের পর বাবাকে কাছে পায়নি ১২ বছরের এ শিশু। যতটুকু দেখা সেটাও ছবির ফ্রেমে। কারণ জন্মের ১১ দিন আগে পৃথিবী থেকে চলে যান বাবা। এরপরও কালো পাঞ্জাবি, পায়জামা পরে বাবার কবরে এসে ফুল দিয়েছে। দুই হাত তুলে করেছে দোয়া।
পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন বাবা মেজর মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম সরকার। বাবার কবরের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছিল ততই যেন সাদাকাতের চোখ ভারি হয়ে উঠছিল। কোনোভাবে নিজেকে সামলিয়ে বাবার কবরে ফুল রাখে ছোট্ট শিশুটি। কিন্তু একপর্যায়ে নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি সাদাকাত। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতো সেও বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর জোয়ানদের বিদ্রোহে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে নিহত হন মেজর মমিনুল ইসলাম। বাবাহারা ১২ বছর। একমুহূর্তের জন্য বাবার ভালোবাসা না পাওয়া সাদাকাত ও তার পরিবারের সদস্যদের এমন আবেগের বহিঃপ্রকাশে কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে যায় বনানী সামরিক কবরস্থানের পরিবেশ। তাদের কান্নার রোলে আপ্লুত হয়ে পড়েন উপস্থিত সাংবাদিক ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও।
বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শহীদ সদস্যদের ১২তম শাহাদাত বার্ষিকীতে মেজর মমিনুলের পরিবারের সদস্যরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসলে এমন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শুধু মেজর মমিনুলের পরিবারের সদস্যরা নয়, এ ঘটনায় নিহত অন্যান্য সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরাও এদিন বনানী কবরস্থানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।
বাবা মেজর মমিনুলের সম্পর্কে ছেলে সাদাকাত সাবরির বিন মমিন বলেন, ‘আমি তো বাবাকে দেখিনি। বাবার নিহতের ১১দিন পর আমি জন্মগ্রহণ করি। তাই বাবার সঙ্গে কোনো স্মৃতি নেই। তবে মা ও নানুর কাছে বাবা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। বাবা একজন সত্য ও আদর্শবান সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। আমিও বাবার মতো আর্মি অফিসার হতে চাই।’
বাবাকে না দেখলেও তাকে সব সময় মনে পড়ে সাদাকাতের। স্কুলের বন্ধুরা যখন নিজেদের বাবাকে নিয়ে গল্প করে, তখন সাদাকাত চুপ হয়ে যায়। তখন মা ও নানুর কাছ থেকে বাবার সম্পর্কে জানা কথাগুলো মনে করে সাদাকাত। নীরবে নিভৃতে সাদাকাত বাবাকে খুঁজতে থাকে। বাবাকে বিডিআর কেমন করে গুলি করে মেরেছে, সেটিও মাঝে মাঝে কল্পনা করে ছোট সাদাকাত।
এ বিষয়ে সাদাকাতের মা সাঞ্জানা সোনিয়া জোবায়দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সাদাকাত তার বাবাকে কখনো দেখেনি। সে যখন তার বাবা সম্পর্কে জানতে চায়, ওর বাবা যেমন ছিল সেটিই আমি বলি। ঘটনা সম্পর্কে আমি সাদকাতকে ইতিবাচক কথা বলি, যাতে করে ওর মধ্যে যেন নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি না হয়। সাদাকাত বলে বাবার মতো আর্মি অফিসার হবে। আমি তখন তাকে বলি, তুমি সবার আগে বাবার মতো একজন আদর্শ মানুষ হও।’
এদিন বনানী সামরিক কবরস্থানে আসা পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত প্রতিটি সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরাও চোখের পানি দিয়ে নিহত স্বজনদের স্মরণ করেছেন। কেউ ফুল দিয়ে কেউবা কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করে আবার কেউবা নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে নিহত স্বজনকে স্মরণ করেন এবং তাদের জন্য দোয়া করেন। সবাই ভিন্ন ভিন্নভাবে স্বজনদের স্মরণ করলেও সবার মধ্যে একটি বিশেষ মিল ছিল। সেটি হল চোখের পানি।
শ্রদ্ধা জানাতে আসা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার চান তারা। এমন ঘটনা কেনো ঘটল সেটি তারা জানতে চান। আর দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন স্বজনরা।
এর আগে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১২তম বার্ষিকী উপলক্ষে সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় শহীদদের কবরে রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহ উদ্দিন ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমেদ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
আরও শ্রদ্ধা জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম আবু আশরাফ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম।
ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো শেষে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা শহীদদের সম্মানে স্যালুট দেন। পরে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানায় সংঘটিত হয় বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। নির্দয় জওয়ানদের গুলিতে প্রাণ যায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তার। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি দুইদিনব্যাপী চলা এ বিদ্রোহে মোট প্রাণ হারান ৭৪ জন।
এমএসি/এমএইচএস