নিরামিষ খিচুড়ি আর বছরে একটি জামা, এই তাদের উৎসব

বাংলাদেশের চা বাগানে যে শ্রমিকরা কাজ করেন তাদের বেশিরভাগই সনাতন ধর্মাবলম্বী। ধর্মীয় রীতিতে সারা বছরই নানা উৎসব লেগে থাকলেও সেসব উৎসবের রঙ লাগে না এই শ্রমিকদের শরীরে।
দুর্গাপূজা ও হোলিতে উৎসব ভাতা পেলেও বেশিরভাগ পরিবারে নতুন পোশাক জোটে শুধু একটি উৎসবেই, সেটিও ছোটদের, তাও আবার অন্য কারও ব্যবহার করা পোশাক। আরেকটি উৎসবের ভাতা চলে যায় ঋণ শোধ করতেই। বড়রা মুখ চেপে বছর পার করে দেন।
দুর্গাপূজার সময়ে যে পোশাক এই শ্রমিকরা কেনেন সেগুলোর দাম ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে। শাড়ি যদি কেনা হয় তার দাম ৩০০-৪৫০ টাকার মধ্যে। রাজধানী ঢাকা থেকে অল্প কিছু নতুন পোশাক সেখানে যায়, যেগুলোর মান ভালো নয়, দাম ৫০০ টাকার মধ্যে।
দুর্গাপূজা আর হোলি, এই দুই উৎসব ঘিরে নিজেরা চাঁদা তুলে ভালো খাবার খান তারা। ভালো খাবার বলতে নিরামিষ খিচুড়ি। কেউ কেউ আবার এসব দিনে মুরগির মাংস কিনতেন। শ্রমিকরা বলছেন, এবার ব্রয়লার মুরগির দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে হয়তো মুরগি কিরতে পারবেন না।
• আরও পড়ুন : ছোট্ট ঘরের এক পাশে গরু, অন্য পাশে চা-শ্রমিকের পরিবার

উৎসব মৌসুমে শ্রীমঙ্গলের চা-শ্রমিক পাড়ায় পোশাক বিক্রি করেন সুমন দেব। কালীঘাট চা-বাগানের শ্রমিকপাড়ায় কাপড় বিক্রির সময় কথা হয় তার সাথে। সামনে দূর্গাপূজা, তাই এই সময় কাপড় বিক্রি করতে এসেছেন তিনি। তবে, পোশাক কেনায় শ্রমিকদের এবার আগ্রহ কম বলে জানালেন মৌসুমি এই কাপড় ব্যবসায়ী।
সুমন দেব জানান, তার কাছে ‘ওয়াশ করা’ কিছু পোশাক আর ঢাকার গাউছিয়া মার্কেট থেকে কেনা কিছু কমদামি নতুন পোশাক আছে। এর মধ্যে বাচ্চাদের পোশাকই বেশি।
তিনি জানান, ১০০ থেকে ৩৫০ টাকার পোশাকই বেশি কেনেন শ্রমিকরা। হাতেগোনা কিছু শ্রমিক আছে, যাদের ছেলেমেয়ে বাগানের বাইরে অন্য কোথাও কাজ করে বা প্রবাসী শ্রমিক, তারা এর চেয়ে বেশি দামের কিছু পোশাক কিনে থাকেন।
• আরও পড়ুন : ‘অভাবী’ শ্রমিকদের কাছে উন্নত চিকিৎসা যেন ‘বিলাসিতা’

ভাড়াউড়া চা-বাগানের শ্রমিক মিঠুন গড় বলেন, বছরে একবারই নতুন পোশাক কেনা হয়। তাও সবার জন্য কিনতে পারি না। বাচ্চাদের জন্য অবশ্য কেনা হয়, আর নিজেদের জন্য টাকা থাকলে কিনি।
তিনি বলেন, আমরা যেগুলোকে নতুন পোশাক বলছি, সেগুলো আসলে অন্য কারো ব্যবহার করা কাপড়। মার্কেটে গিয়ে নতুন পোশাক কেনার ক্ষমতা তো আর আমাদের নেই।
জানা গেছে, একটি বাগানের শ্রমিকদের বেশ কয়েকটি ভাগ থাকে। এর মধ্যে প্রধান ভাগ হলো স্থায়ী শ্রমিক এবং অস্থায়ী শ্রমিক। প্রতিটি বাগানের মোট শ্রমিকের তিন ভাগের এক ভাগ অস্থায়ী শ্রমিক থাকেন। স্থায়ী শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরি পান। অস্থায়ী শ্রমিকদের মজুরি আরও কম। স্থায়ী শ্রমিকদের ৪৭ দিনের মজুরির সমান বোনাস দেওয়া হয়। টাকার পরিমাণ ৫ হাজার ৬৪০ টাকা। এই বোনাসের টাকাও আবার দুই ভাগে দেওয়া হয়। দুর্গাপূজার সময় ৬০ শতাংশ এবং ফাগুয়া বা হোলি উৎসবে দেওয়া হয় ৪০ শতাংশ। অস্থায়ী শ্রমিকরা এই বোনাস পান না।
চা-শ্রমিকদের অভিযোগ, বোনাসের টাকা নিয়েও নয়ছয় করে মালিকপক্ষ। প্রাপ্য ছুটি বাদে বছরের সব দিন কাজ করলেও সবাইকে একই পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয় না। বিনা কারণে অনেকের টাকা কেটে রাখা হয়। ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১০০ দিন ছুটি পাওয়া যায়। এর বাইরে ২৬৫ দিন কাজ করলেই কেবল পুরো বোনাস দেওয়া হয়। কেউ যদি ২৬৫ দিনের একদিনও কম কাজ করেন, তাহলে তার উপস্থিতি ধরা হয় ৭৫%। আর ২৫০ দিনের চেয়ে একদিন কম কাজ করলে তার উপস্থিতি হয়ে যায় ৫০%।
কিন্তু শ্রমিকরা জানেনই না আসলে তাদের কত টাকা প্রাপ্য ছিল বা কম দেওয়া হলো। আবার মালিকপক্ষ যদি বলে, কোনো শ্রমিক সবদিন কাজ করেনি, সেটাই নিরবে মেনে নেন শ্রমিকরা।
শ্রমিকরা জানান, মজুরি বা বোনাস নিয়ে কথা বললেই তাকে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে আক্রোশের বশে তাকে বিনা কারণে ‘চার্জশিট’ দেওয়া হয়। এই চার্জশিট হলো অনেকটা ফুটবল খেলার হলুদ কার্ডের মতো। এটা দেওয়া হয় সতর্ক করার জন্য। এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয় যে, কেউ যদি আবারও একই ধরনের ‘অপরাধ’ করে তবে তাকে বাগান থেকে বের করে দেওয়া হবে, বসবাস করার জায়গা কেড়ে নেওয়া হবে।
• আরও পড়ুন : চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতিকে শ্রমিকদের মারধর

অক্টোবরে দুর্গাপূজা, চিন্তায় শ্রমিকরা
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা আসছে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে। কিন্তু মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে অনড় শ্রমিকরা এখনও কাজে যোগদান করেননি। এর ফলে এবারের দুর্গাপূজা উপলক্ষে উৎসব ভাতা পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন তারা।
কালীঘাট চা-বাগানের শ্রমিক খোকন চাষা বলেন, গত বছরের দুর্গাপূজায় সব শেষ নতুন পোশাক কিনেছি। এবার কী হবে জানি না। আন্দোলনের কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে। সে কারণে মালিকপক্ষ বোনাস না দিলে নতুন পোশাকও জুটবে না কারও কপালে। ভালো খাবারও খাওয়া হবে না হয়তো।
তিনি বলেন, মজুরির টাকায় সংসার চলে না। এদিকে ঘরও নড়বড়ে। সে কারণে দুইটা এনজিও থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। প্রতি মাসে ২৭০০ টাকা করে কিস্তি দিতে হচ্ছে। এবার যদি বোনাসের টাকা না পাই, জানি না কী হবে।
এএজে/এনএফ