স্বাধিকার আন্দোলন জোরদার, গুলিতে বাড়ে মৃতের সংখ্যা

৫ মার্চ, ১৯৭১। এদিন স্বাধিকার আন্দোলন আরও জোরদার হয়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গুলিতে বাড়ে মৃতের সংখ্যাও। একাত্তরের এই দিনে চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৮ জনে দাঁড়ায়। টঙ্গীতে গুলিবর্ষণে নিহত হন ৪ জন। আহত হন অন্তত ২৫ জন। যশোরেও নিহত হন মুক্তিকামী এক বাঙালি। রাজশাহী, রংপুরে আবার কারফিউ জারি হয়।
গণহত্যার সংবাদে রাজধানীসহ সারাদেশে মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। মিছিল-প্রতিবাদ সভায় কেঁপে ওঠে অত্যাচারী শাসকের ভিত। এই দিনে ঘটে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে ৩২৫ কয়েদি মিছিল করে শহীদ মিনারে চলে আসেন। কারাগারের ফটক ভাঙার সময় প্রহরীর গুলিতে প্রাণ হারান সাত জন।
কয়েদিদের এ ঘটনা মুক্তিকামী জনতার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। জনতা টঙ্গী ব্রিজের কাঠের অংশ উপড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেয় রাস্তা। জনতার ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে একাত্তরের এই দিনে পালিত হয় দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল।
মুক্তিকামী বাঙালির উত্তাল ও অপ্রতিরোধ্য দুর্বার আন্দোলনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিত নড়ে ওঠে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণাকে অবাঞ্ছিত ও অগণতান্ত্রিক ঘোষণা করে বেলুচিস্তান ন্যাপ। এ ছাড়া ‘সংখ্যাগুরু দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশের সংহতি রক্ষা করা অপরিহার্য’ বলে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আসগর খান মন্তব্য করেন। মাওলানা গোলাম গাউস হাজারী জানিয়ে দেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সব নির্বাচিত সদস্যের পক্ষ থেকে ভুট্টোর কথা বলার অধিকার নেই। মানিক গোলাম জিলানী বলেন, অবিলম্বে সংখ্যাগুরু দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এসব নেতার কারো বক্তব্যকেই গুরুত্ব দেয়নি।
এদিকে প্রতিটি বাঙালির চোখে তখন স্বাধীনতার স্বপ্ন। সবাই ভাবছে কবে আসবে সেই দিনের ডাক, যেদিন দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে তারা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে যুদ্ধে এবং পাবে একটি স্বাধীন দেশ। দুপুরে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে থেকে ‘বাঁশের লাঠি তৈরি কর-পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর’ স্লোগান দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ বিশাল লাঠি মিছিল বের করে।
ঢাকায় এদিন ছাত্রলীগের লাঠি মিছিলে অংশ নেয় স্বতঃস্ফূর্ত জনতা। একাত্মতা ঘোষণা করে ডক্টর আহমদ শরীফের নেতৃত্বে শহীদ মিনারে শপথ নেন ঢাকার লেখক-শিল্পীরা। বাঙালি উপলব্ধি করতে থাকে পাক হানাদারদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার একমাত্র পথ সশস্ত্র সংগ্রাম। সময় যত গড়াচ্ছিল মুক্তিকামী জনতার উত্তাল আন্দোলন তত অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি অনুযায়ী এই দিনেই পাক সামরিক জান্তা রাজপথ ছেড়ে ব্যারাকে ফিরে যায়।
এদিন গভীর রাতে পাওয়া এক খবরে জানা যায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে পাঁচ ঘণ্টা ম্যারাথন বৈঠক করেন।
১৯৭১ সালের ৫ মার্চ স্বাধিকার আন্দোলনে শামিল হন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। চলমান দমন-পীড়নকে গণহত্যা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি বিবৃতি দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ ও যে কোনও ত্যাগ স্বীকারের ঘোষণা দেন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা।
একাত্তরের এই দিনে ক্ষুব্ধ বাঙালির মিছিলে মিছিলে ঝাঁঝালো স্লোগানে উচ্চকিত ছিল সারাদেশ। প্রধান স্লোগান ছিল- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।
এদিকে ৭ মার্চ যতই এগিয়ে আসতে শুরু করে, স্বাধীনতাকামী বাঙালি ও পাক সামরিক জান্তার মধ্যে উত্তেজনা ততই বাড়তে থাকে। দ্রোহ-ক্ষোভে বঞ্চিত-শোষিত বাঙালি তখন ক্রমেই ফুঁসে উঠেছিল ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে। তারা একবুক প্রত্যাশা নিয়ে বসে থাকে ৭ মার্চ কী ঘোষণা দেবেন বঙ্গবন্ধু।
অন্যদিকে পাক সামরিক জান্তা ভয়ে কাতর, যদি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন কী হবে? এমন আতঙ্ক, ভয় তাদের তাড়িত করে।
সূত্র : ১৯৭১ সালের ৬ মার্চের দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও অন্যান্য
এইচকে
