নিরাপত্তা দিয়েছে, পরিবারের দায়িত্বও পালন করেছে পুলিশ

২০২০ সালের ১৪ জুলাই। করোনা আতঙ্কে সারাদেশের মানুষ যখন ঘরবন্দি তখন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার ৭০ বছরের বৃদ্ধ সোবাহান আলীর জ্বর আর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। করোনা সংক্রমণের আতঙ্কে বৃদ্ধ বাবাকে উল্লাপাড়া পৌর বাস টার্মিনালে ফেলে যায় ছেলে। সেই সোবাহান আলীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে ছেলের ভূমিকা পালন করেন স্থানীয় পুলিশ সদস্যরা।
শুধু ওই ঘটনা নয়, করোনাকালে এমন অনেক মানবতার জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের তথ্য জানানো হয়। ওই খবর জানার পর দেশের মানুষের মধ্যে অজানা এক আতঙ্ক ভর করে। মহামারি প্রতিরোধে সরকার লকডাউনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। একে একে বন্ধ ঘোষণা করা হয় স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত। সেই সঙ্গে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়। সর্বত্র ভয়ার্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঠিক সে সময় ত্রাতা হয়ে আসে পুলিশ। পাশাপাশি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র্যাব) মানুষের পাশে দাঁড়ায়।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, করোনা মহামারির শুরুর দিকে মানুষ যখন আতঙ্কে ঘর থেকে বের হতো না, তখন পুলিশ সদস্যরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। জননিরাপত্তা থেকে শুরু করে করোনায় মৃতদের দাফনের কাজও করেছে পুলিশ। লকডাউনের সময় যাদের ঘরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট ছিল, পুলিশকে ফোন দিলেই তাদের ঘরে পণ্য পৌঁছে যেত। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট অসহায় মানুষের মধ্যে খাদ্যও বিতরণ করে।
করোনা আতঙ্কেও রাজপথ ছাড়েনি পুলিশ
করোনার আতঙ্কের সময় যখন দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ঘরবন্দি ছিলেন, ঠিক তখনই অন্যতম সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে রাজপথে ছিল পুলিশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসুরক্ষাসহ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুরক্ষা ছাড়াই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন পুলিশ সদস্যরা। করোনার সংক্রমণ কমাতে লকডাউনের নীতিমালা সারাদেশের মানুষকে মানতে ও বোঝাতে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে পুলিশ। আতঙ্কে লোকজন যখন শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটছিলেন, তখন তাদের যাত্রা এবং শহরে অবস্থানকারীদের বাসাবাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন তারা। করোনার সময় এসব দায়িত্ব পালন করতে কোনো পুলিশ সদস্য হাঁপিয়ে উঠলেও দায়িত্বে অবহেলা করেননি।
বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছানো
করোনার শুরুর দিকে দীর্ঘ লকডাউনের কারণে খেটে খাওয়া মানুষরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েন। দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকায় অর্থের অভাবে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। এ সময়ও ত্রাতা হয়ে আবির্ভাব হয় পুলিশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন খেটে খাওয়া মানুষের খোঁজ নিয়ে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট রান্না করা খাবারসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। যা চলমান ছিল লকডাউন শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
চিকিৎসা থেকে দাফন
করোনার শুরুর দিকে কোনো মানুষ আক্রান্ত হলে তাকে পরিবারসহ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হতো। কেউ তাদের পাশে দাঁড়াত না। আক্রান্ত রোগীদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ারও দাবি তোলেন অনেকে। আক্রান্তরা যখন পরিবার কিংবা সমাজের কারও সাহায্য পাচ্ছিলেন না, তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় পুলিশ। আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন তারা। প্রথমদিকে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা মারা যেতেন, তাদের অধিকাংশেরই মরদেহ পরিবার নিত না। এসব মরদেহের দাফন অথবা সৎকারের কাজ করে পুলিশ।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা
দেশে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে এনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আর করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে পুলিশ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে একজন মানুষের ঘর থেকে বের হওয়া এবং ঘরে ফিরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশ সদস্যরা। এখনও তারা যথাযথভাবে কাজটি করে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানায় অসংখ্যবার অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছে সংস্থাটি। এছাড়া ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ নীতি বাস্তবায়নেও কাজ করছে পুলিশ।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) মো. সোহেল রানা এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ সবসময়ই জননিরাপত্তা নিশ্চিত এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে। করোনাকালে বাংলাদেশ পুলিশের মানবিক দিকটিও দেখেছে সারাবিশ্ব। এ সময় পুলিশের লাখ লাখ সদস্য নিজেদের ও পরিবারের কথা চিন্তা না করে দেশের মানুষের কল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অনেক মরদেহ রাস্তায় পড়েছিল, করোনা আশঙ্কায় সেগুলোর সামনে যায়নি কেউ। বাংলাদেশ পুলিশ তাদের মরদেহ দাফন-সৎকার করেছে। এমনকি নিজ উদ্যোগে বাড়ি বাড়ি খাবারসহ জরুরি জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়েছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে দায়িত্বের বাইরে গিয়ে অনেক কাজ করেছে পুলিশ। এসব কাজ করতে গিয়ে যেসব সদস্য প্রাণ দিয়েছেন, তাদের কাছে বাংলাদেশ পুলিশ কৃতজ্ঞ।
পুলিশ সদর দফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, শুধু এসব কাজই নয়, করোনা মহামারির শুরু থেকে জনমনে আতঙ্ক নিরসনে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে গেছে। এছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণে যেসব দায়িত্ব পুলিশের ওপর অর্পিত ছিল, তা যথাযথভাবে পালন করেছেন বাহিনীর প্রতিটি সদস্য।
জানা যায়, করোনায় পুলিশের প্রায় ৮৬ জন সদস্য মারা গেছেন। এছাড়া সুস্থ হয়ে করোনাপরবর্তী জটিলতায় মারা গেছেন এপিবিএন-১১ এর সহকারী পুলিশ সুপার ইসরাত জাহান। পুলিশ বাহিনীতে মারা যাওয়াদের মধ্যে অধিকাংশই কনস্টেবল ও এসআই'র মতো মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের কনস্টেবল রঘুনাথ রায়, ডিএমপি ট্রাফিকের জালাল উদ্দিন, স্পেশাল ব্রাঞ্চের মজিবুর রহমান তালুকদার, পিবিআইয়ের অনিতা রানী রায় উল্লেখযোগ্য।
সবশেষ ৫ মার্চের তথ্য অনুযায়ী, করোনার সময় মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে ১৬ হাজার ৫৬৪ জন পুলিশ সদস্য এবং দুই হাজার ৫২২ জন র্যাব সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন ১৬ হাজার ৪২৪ জন পুলিশ সদস্য এবং দুই হাজার ৫০৯ জন র্যাব সদস্য।
এমএসি/এআর/জেডএস/এমএমজে
