পল্টনে মাওলানা ভাসানীর ভাষণ

৯ মার্চ, ১৯৭১। এদিন ঢাকা শহর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর এদিন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হমিদ খান ভাসানী। উত্তাল এই দিনে ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি একাত্বতা প্রকাশ করে ভাষণ দেন তিনি।
পল্টনের জনসভায় ভাসানী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে বলেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয়, তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। “লা-কুম দিনিকুম অলিয়া দ্বীন” অর্থাৎ তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার; পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।’
জনসভায় মাওলানা ভাসানী তুমুল করতালির মধ্যে বলেন, ‘মুজিবের নির্দেশমতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলব। ইয়াহিয়া খান, তোমার যদি পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচ কোটি মানুষের জন্য দরদ থাকে তাহলে তুমি পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন ঘোষণা কর। এতে করে দুই পাকিস্তানে ভালবাসা থাকবে, বন্ধুত্ব থাকবে। কিন্তু এক পাকিস্তান আর থাকবে না, থাকবে না, থাকবে না!’
পল্টনে সেই বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা দৃঢ় কণ্ঠে আরও বলেন, ‘অচিরেই পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবে।’ তিনি সবাইকে শেখ মুজিবের ওপর আস্থা রাখতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিব আমার ছেলের মতো, সে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না; বাঙালিরা মুজিবের ওপর আস্থা রাখেন, কারণ আমি তাকে ভালোভাবে চিনি।’

এই দিন তিনি ভাষণের সঙ্গে ১৪ দফা দাবিও পেশ করেন। মাওলানা ভাসানী এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন।
ভাসানী বলেন, ‘আমি অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করি না। অহিংসার কথা বাদ দাও, এটা অবাস্তব। আমার নবী (সা.) বলতেন, প্রথমে আক্রমণ করো না। কিন্তু কেউ যদি আক্রমণ করে তার তেরটা কেন চৌদ্দটা বাজিয়ে দাও।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সাত কোটি মানুষ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ায় তাদেরকে মোবারকবাদ জানান ভাসানী।
পশ্চিম পাকিস্তানিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনো আইন পাস করে আপনাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আপনারা বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানাতে পারতেন। পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষ আপনাদের সমর্থন করত।’
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে মাওলানা বলেন, ‘বাঙালি, বিহারি, হিন্দু, মুসলমান— সকলেই এ দেশের অধিবাসী। এদের জানমাল রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। বিহারিরা পশ্চিমা নয়।’
ওয়াপদা ফেডারেশনের ১৬ জন নেতা যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ‘এক মরণজয়ী সংগ্রাম’ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
পল্টনে জনসভায় মাওলানা ভাসানী ঘোষণা করেন ২৫ মার্চের পর শেখ মুজিবের সাথে আন্দোলন করবেন। টেলিফোনে মুজিব ভাসানী আলোচনা হয়। ভাসানীর বক্তব্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থিদের অংশগ্রহণ আরও শক্তিশালী হয়।
রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর পূর্ব বাংলা হয়ে ওঠে মুজিবময়। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে দিয়েছিলেন চার শর্ত, আর বাংলার মুক্তিকামী মানুষকে দিয়েছিলেন ১০ নির্দেশনা। তার ভিত্তিতেই ৮ মার্চ থেকে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। হাই কোর্টের বিচারক থেকে সাধারণ নাগরিক সবাই তাতে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়। পূর্ব পাকিস্তান কার্যত চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশে।
পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলায় তাদের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলে। পাক সামরিক জান্তার কোনও নির্দেশ কেউই মানে না। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু নির্দেশেই চলতে থাকে গোটা দেশ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। বিভিন্ন স্থানে চলে গোপন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি। অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা অফিসার-সৈনিকরা গোপনে নানা স্থানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর দামাল ছেলেদের।
এদিন এদিন রাজশাহীতে কারফিউ জারি হয়। বঙ্গবন্ধু আহূত অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের অষ্টম দিন ৯ মার্চ সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। যানবাহন, জরুরি সার্ভিস ও ব্যাংক ছাড়া হাইকোর্ট, জজ কোর্ট, আধা সরকারি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ঘরে ঘরে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়। যানবাহন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা কালো ব্যাজ ধারণ করেন। স্টেট ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংক বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো বন্ধ রাখে। দেশের সর্বত্র মিছিল-মিটিং অব্যাহত থাকে।
এদিন মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি পরিবর্তন করে সামরিক শাসন পরিচালক পদে লে জে টিক্কা খানের নিয়োগ। উল্লেখ্য, ৬ মার্চ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের জরুরি সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এই সভায় আরেকটি প্রস্তাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বাংলাদেশে জাতীয় সরকার’ গঠনের জন্য অনুরোধ করা হয়।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের শপথ নেওয়া হয়। অপর এক প্রস্তাবে ‘ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস’ নামকরণ করা হয়।
এছাড়া পৃথক বিবৃতিতে বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন, আদমজী শ্রমিক ইউনিয়ন, বিমান পরিবহন কর্মচারী ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের কর্মচারীরা স্বাধিকার আন্দোলনের শহীদদের জন্য আওয়ামী লীগের রিলিফ তহবিলে একদিনের বেতন দান করেন।
এদিকে ঢাকা থেকে বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নিতে স্ব-স্ব দেশ থেকে বিমানের ঢাকায় অবতরণ করে। জাতিসংঘের মহাসচিব ‘প্রয়োজনবোধে’ জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারকে অপসারণের নির্দেশ দেন বলে জানায় রয়টার্স।
তথ্যসূত্র- ১৯৭১ সালের ৯ মার্চের দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান, আজাদ, রয়টার্স, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওয়েবসাইট ও অন্যান্য।
এইচকে