থমথমে বসুরহাট, শান্তি চায় সাধারণ মানুষ
চাঁদপুরের বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম। কাঠমিস্ত্রির সহকারী ছিলেন ১২ বছর। করোনা পরিস্থিতির কারণে সম্প্রতি পেশা পরিবর্তন করে শুরু করেছেন মাস্ক, রুমাল ও গামছার ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা। শুরুটা ফেনীতে হলেও খরচ বেশি হওয়ায় ঠাঁই হয়নি বেশিদিন। মাসখানেক আগে কম খরচের জন্য এসে বসতি গড়েছেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে। কিন্তু এখানকার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাকে খুব বিপাকে ফেলেছে।
নাজমুল ইসলাম বলেন, কম খরচের জন্য এখানে আসছি। কিন্তু একই দলে হানাহানির জন্য আমাদের মত গরিব মানুষের পেটে লাথি। এখন বাসা ছাড়তে গেলে দুইমাসের ভাড়া দিতে হবে, নিজের পেটই তো চলছে না।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বসুরহাট পৌরসভার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি অটোরিকশা ও সিএনজি। এসব যানের চালকরা যাত্রীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। কিন্তু যাত্রীর দেখা নেই। হঠাৎ এক যাত্রী আসতেই তাকে নিজের গাড়িতে নেওয়ার জন্য টানাটানি লেগে যায়। সেখানে কথা হয় অটো ও সিনজিচালকদের সঙ্গে। তারা জানান, গত দুইদিন ধরে মালিকের ভাড়া তুলতেই বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।
স্বপন নামক এক অটো রিকশাচালক বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০০ টাকা ভাড়া উঠাতে পারিনি। মালিককেই জমা দেওয়া লাগবে ৩০০ টাকা। জীবনের রিস্ক নিয়ে বের হইছি, কী লাভ হল বলেন?
কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌর নির্বাচনের দিনদশেক আগে থেকেই এখানকার আওয়ামী লীগের রাজনীতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। উত্তপ্ত রাজনীতির কেন্দ্রে পৌর মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। নিজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে নির্বাচনের আগে অভিযোগ তোলেন। তবে নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পান তিনি।
জয়ের পর থেকে নিজ দল আওয়ামী লীগের নেতাদের অপরাজনীতি, এমনকি বড় ভাই ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিয়েও বিতর্কিত মন্তব্য করতে থাকেন। আর এতে নতুন মাত্রা যোগ করেন নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য ও নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী।
এরকম উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চাপরাশির হাট পূর্ব বাজারে কাদের মির্জা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় গুলিবিদ্ধ হন দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা বাজারের স্থানীয় প্রতিনিধি বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির। পরদিন রাত পৌনে ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোম্পানীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খিজির হায়াত খানসহ কয়েকজন নেতাকে বহিস্কারের ঘটনা ঘটে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (৯ মার্চ) কাদের মির্জা ও মিজানুর রহমান বাদলের সমর্থকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় আলাউদ্দিন নামে এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অন্তত শতাধিক ব্যক্তি। এরই প্রেক্ষাপটে দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও সংঘর্ষের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় ১৪৪ ধারা চলে বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। সরেজমিনে বুধবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বসুরহাটের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখা গেছে, থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও র্যাব টহল দিচ্ছে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জাকির হোসেন খান ,পিপিএম (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে তার ব্যবস্থা নিচ্ছি। পরবর্তী সময়ে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক র্যাব কর্মকর্তা জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিরাপত্তা ইস্যুতে অনেক ব্যবসায়ী আপাতত দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন। মঙ্গলবারের সংঘর্ষের পর বুধবার বসুরহাটের বেশিরভাগ দোকানপাট খোলেনি। শহরে সাধারণ লোকজনের উপস্থিতি অনেক কম। খুব প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বের হতে দেখা যায়নি।
পৌরসভার করালিয়া, জিরো পয়েন্ট ও রুপালি চত্বরে দোকান খোলা রাখা ব্যবসায়ীরা জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মাসখানেক ধরে ব্যবসা পরিস্থিতি খারাপ যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
জামাল উদ্দিন নামক এক ব্যবসায়ী বলেন, ক্ষমতা নিয়ে দলে দলে দ্বন্দ্বের জেরে আমরা সাধারণ মানুষ তো মাঠে মারা যাচ্ছি। সবসময় নিজের জীবন নিয়ে ভয়ে থাকি, কখন কী ঘটে। আমরা আর পারছি না।
পৌরসভার জিরো পয়েন্টে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, কেন তারা এমন করে আমাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে? কতদিন এসব সহ্য করা যায় বলেন। এদিকে মঙ্গলবারের সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৮ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
এনআই/আরএইচ