ডাকের চালানে আসা অস্ত্র ‘আসল’ নয়, আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বৈদেশিক ডাকে আসা একটি চালানে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র এবং কার্তুজগুলো আসল নয়। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় পৃথক আইনে তিনটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ।
যদিও মামলাটিতে চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগে কর্মরত উচ্চমান সহকারী মজুমদার কামরুল হাসান (৪২) তিন মাসের বেশি সময় কারাভোগ করেছেন। তবে আদালতে দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তিনিসহ মামলার প্রধান আসামি রাজিব বড়ুয়াকে (৩৭) অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। বর্তমানে তিনটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে শুনানির অপেক্ষায়।
আদালত সূত্র জানায়, ৯ জানুয়ারি বিশেষ ক্ষমতা ও অস্ত্র আইনে দাখিল করা দুটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ধার্য তারিখ ছিল। এ দিন মজুমদার কামরুল হাসান (৪২) আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত তাকে জামিন দেন। একই দিন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী দুটি মামলায় নারাজি আবেদনের জন্য সময় আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি মামলা দুটির তারিখ নির্ধারণ করেন। এছাড়া কাস্টমস আইনে দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদন আগামী ১৫ জানুয়ারি আদালতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গেল বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা জ্যোৎস্না আক্তার বন্দরের প্রধান ডাকঘরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই সময় ইতালির রোম থেকে আসা একটি চালানে কায়িক পরীক্ষা শেষে দুটি ৮এমএম পিস্তল, দুটি সদৃশ খেলনা পিস্তল ও ৬০টি কার্তুজ জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় ওইদিন রাতে কাস্টমস হাউসের এআইআর শাখার ডেপুটি কমিশনার শরফুদ্দিন মিঞার নির্দেশে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে বন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
আলোচিত মামলাটিতে চালানটির প্রাপক মজুমদার কামরুল হাসানকে প্রধান এবং প্রেরক রাজীব বড়ুয়াকে আসামি করা হয়। কামরুল হাসান মজুমদার চট্টগ্রাম আয়কর কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত এবং তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নে। তার বাবার নাম গোলাম ছত্তার মজুমদার। এছাড়া রাজীব বড়ুয়ার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নে। তার বাবার নাম ফনি ভূষণ বড়ুয়া।
মামলাটিতে দুই আসামির বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে পার্সেলের মাধ্যমে গৃহাস্থালি সামগ্রীর সঙ্গে অসত্য ঘোষণায় চোরাচালানের মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র আনার অভিযোগ আনা হয়। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইন, কাস্টমস আইন এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করা হয়।
এদিকে মামলা দায়েরের পরপরই ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে মজুমদার কামরুল হাসানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। একই সঙ্গে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে ৩ মাস কারাগারে থাকার পর ওই বছরের ২৪ মে জামিন পান তিনি। এরই মধ্যে বন্দর থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্ত করতে থাকেন ওই থানায় কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ফয়সাল সরোয়ার। তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি আদালতে পৃথক আইনে তিনটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
সেখানে উল্লেখ করা হয় বন্দরের প্রধান ডাকঘরে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গুলি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) চট্টগ্রাম এবং সিআইডি ঢাকা মহাখালী কার্যালয়ের ফরেনসিক ল্যাবের ব্যালেস্টিক শাখায় পরীক্ষা করানো হয়। সেখান থেকে তারা মতামত দেন অস্ত্রগুলো দিয়ে ফায়ার করা হলে কেবলমাত্র শব্দ সৃষ্টি হয়। এগুলোর ব্যারেলে প্রতিবন্ধকতা থাকায় কোনোপ্রকার বুলেট বা পিলেট বের হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এ হিসেবে এগুলো আগ্নেয়াস্ত্র নয় বলে প্রতীয়মান হয়।
এছাড়া জব্দ হওয়া কার্তুজগুলো প্রজেক্টাইলবিহীন, যাতে কেবলমাত্র শব্দ সৃষ্টি হয়। যেহেতু কার্তুজগুলোতে কোনো বুলেট বা পিলেট নেই সেহেতু এগুলো আগ্নেয়াস্ত্রের নয়। আবার জব্দ হওয়া দুটি অস্ত্রের ব্যারেলের উপরিভাগে দুটি ছিদ্র রয়েছে, যার মাধ্যমে ফায়ার করলে প্রচণ্ড ধোঁয়া ও শব্দ সৃষ্টি হয় মাত্র। এসব অস্ত্র-গুলি সিনেমা, মুভি, থিয়েটার, দৌড়-সাঁতার প্রতিযোগিতা শুটিং প্রাক্টিসের কাজে ব্যবহার করা হয়।
সার্বিক তদন্ত শেষে বন্দর থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) ফয়সাল সরোয়ার দুই আসামিকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করে তিনটি পৃথক চূড়ান্ত প্রতিবেদন (তথ্যগত ভুল) আদালতে জমা দেয়।
মজুমদার কামরুল হাসানের তিন মাস কারাভোগ নিয়ে প্রশ্ন?
বৈদেশিক ডাকের চালানে অস্ত্র ও গুলি আসা নিয়ে আলোচনা হয় চট্টগ্রামজুড়ে। ইতালি থেকে চালানটি পাঠিয়েছিলেন রাজিব বড়ুয়া। চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ সরকারি কলোনীতে আগে থেকে পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি মজুমদার কামরুল হাসানের নামে চালানটি পাঠিয়েছিলেন বলে জানা যায়। একটি ব্লেন্ডার মেশিন ও কিছু চকলেট পাঠাবেন বলে মজুমদারকে আগে থেকে জানিয়েছিলেন রাজীব। তবে চালানে পিস্তল সদৃশ কিছু পাঠাবেন সেটি জানাননি রাজীব।
ভুক্তভোগী মজুমদার, তার আইনজীবী ও স্বজনদের অভিযোগ, চালানটি ইতালি থেকে পাঠিয়ে বাংলাদেশে আসেন রাজীব। তবে চালানটি আটক হওয়ায় গা-ঢাকা দেয় রাজীব। মামলার বেড়াজালে আটকে যায় মজুমদার। নগরের সিনিয়র সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা অনেকটা ‘বাহবা কুড়াতে’ তড়িঘড়ি করে মজুমদারকে গ্রেপ্তার করে। যদিও গ্রেপ্তার করা ওই কর্মকর্তা বন্দর থানার কোনো দায়িত্বে ছিলেন না বলে জানা যায়। পরে সিআইডির ল্যাবে পরীক্ষা করে জানা যায়, উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গুলি আসল নয়।
এ বিষয়ে সোমবার (৯ জানুয়ারি) মজুমদার কামরুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি জানিও না, আমার নামে চালান আসছে। অথচ পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠালেন। আবার পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারলেন এটি খেলনার পিস্তল। আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলেন। এখন আমাকে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। যার কারণে আমাকে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
মজুমদার কামরুল হাসানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শেখ সরফুদ্দিন সৌরভ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সবাই সবকিছু ফিরে পাবে। আমার মক্কেলের জীবন থেকে চলে যাওয়া তিন মাস কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। উনি একজন সরকারি চাকরিজীবী। একটা মামলার পর তো উনি পলাতক হয়ে যেতেন না। পুলিশ চাইলে আরও তদন্ত করে উনাকে গ্রেপ্তার করতে পারতেন। অনেকটা অতি উৎসাহী হয়ে তারা মজুমদারকে গ্রেপ্তার করেছেন।
বন্দর থানার এসআই ফয়সাল সরোয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এজাহার জমা দিয়েছে। সেই এজাহারের পরিপ্রেক্ষিতে থানায় মামলা রুজু হয়েছে। আইনি নিয়ম হচ্ছে এজাহারভুক্ত আসামি গ্রেপ্তার করার। পুলিশ অভিযান চালিয়ে প্রধান আসামি মজুমদারকে গ্রেপ্তার করেছে। অপর আসামি পলাতক ছিলেন। তাকে চেষ্টা করেও আমরা গ্রেপ্তার করতে পারিনি। তবে মামলাটির তদন্ত এবং অস্ত্র-গুলি পরীক্ষায় জানা যায় এসব আসল ছিল না। তাই দুই আসামিকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়েছে।
এমআর/এসএম
