৮৯ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে নেই আল্ট্রাসনোগ্রাম

ডাক্তাররা এখন রোগীর রোগ নির্ণয়ে প্রথমেই আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি এবং রক্ত পরিসঞ্চালন পরীক্ষা দেন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই সেবাবিহীন চলছে দেশের জেলা-উপজেলা সদর হাসপাতালগুলো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলাদেশের জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফলে এই চিত্র উঠে এসেছে।
সোমবার (২৩ জানুয়ারি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল মিলনায়তনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। এসময় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ।
ডাক্তারদের এই টিম নভেম্বর ২০২০ সাল থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত অর্থাৎ ৮ মাস পরিশ্রমের মাধ্যমে এই প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪১ দশমিক ২ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে রয়েছে রক্ত পরিসঞ্চালন সেবা। বাকি ৫৯ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে নেই রক্ত পরিসঞ্চালন সেবা।
মাত্র ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ জেলা এবং ১১ দশমিক ৮ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে রয়েছে আল্ট্রাসনোগ্রামের ব্যবস্থা। বাকি ৮৯ শতাংশ উপজেলা এবং ৫৬ শতাংশ জেলাতে নেই আল্ট্রাসনোগ্রামের ব্যবস্থা। আর ইউসিজি নেই ১২ শতাংশ জেলা এবং ২৪ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে। শুধু তাই নয়, যে হাসপাতালগুলোতে এই সেবা রয়েছে সেগুলো ভালোভাবে কাজ করছে না।
চিকিৎসকদের মতে, মূলত অতি উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের অভ্যন্তরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি দেখে রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি হচ্ছে আলট্রাসনোগ্রাম। তারা বলছেন, রোগ নির্ণয়ে রক্ত পরীক্ষা, আল্ট্রাসনোগ্রাম এবং ইসিজি পরীক্ষা থাকা খুবই জরুরি। এগুলো ছাড়াই বছরের পর বছর চলছে হাসপাতালগুলো।
গবেষণাটি করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান গবেষক ডা. মো. খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন একটি টিম।
গবেষণার উদ্দেশ্য : বাংলাদেশের জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মো. খালেকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের বড় সংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওপর নির্ভরশীল। এই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার সময় চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, যা সঠিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রধান অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। চ্যালেঞ্জগুলো জেনে সেগুলো সমাধান করা গেলে কর্মস্থলে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি কমিয়ে উন্নত সেবা দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। তাই এই গবেষণা করা হয়েছে।
গবেষণার পদ্ধতি : বাংলাদেশের ৯টি জেলা হাসপাতাল এবং ১৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্ভে চেকলিস্টের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোর সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি ৭৭ জন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা/সিভিল সার্জন/সুপারিন্টেনডেন্ট/মেডিকেল অফিসার/আবাসিক মেডিকেল অফিসারদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য পর্যালোচনা করে গবেষণাটি সম্পন্ন করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল : জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিষেবা দেওয়ার বর্তমান অবস্থা—
১. শতভাগ জেলা হাসপাতালে রক্ত পরিসঞ্চালন সেবা থাকলেও ৪১ দশমিক ২ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই সেবাটি পাওয়া যায়নি।
২. জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যথাক্রমে ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৪১ দশমিক ২ শতাংশ ক্ষেত্রে এক্স-রে পরিষেবা পাওয়া গেছে।
৩. ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ জেলা হাসপাতাল এবং ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইসিজি পরিষেবা পাওয়া গেছে।
৪. ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ জেলা হাসপাতালে এবং ১১ দশমিক ৮ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আল্ট্রাসনোগ্রাম সুবিধা পাওয়া গেছে।
৫. ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশ জেলা হাসপাতালে এবং ৬৪ দশমিক ৭ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মহিলা রোগীদের-অ্যাটেনডেন্টদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি।
৬. শতভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য ডরমিটরি-কোয়ার্টার সুবিধা থাকলেও জেলা হাসপাতালে এর উপস্থিতি ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
৭. ৫২ দশমিক ১ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য ব্যবহার উপযোগী ডরমিটরি/কোয়ার্টার পাওয়া গেলেও জেলা হাসপাতালে এর পরিমাণ শূন্য শতাংশ।
৮. ২০ শতাংশ জেলা হাসপাতালে এবং ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের ডরমিটরি/কোয়ার্টারে গার্ড থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুমোদিত পদের বিপরীতে শূন্য পদের চিত্র—
১. জেলা হাসপাতালে ৩০ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৩ শতাংশ আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে।
২. জেলা হাসপাতালে ৫১ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭৭ শতাংশ জুনিয়র/সিনিয়র কনসালটেন্ট পদ শূন্য রয়েছে। জেলা হাসপাতালে ৬৫ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩৮ শতাংশ মেডিকেল অফিসার/সহকারী সার্জন পদ শূন্য রয়েছে।
৩. নার্সিং স্টাফ/মিডওয়াইফ পদের ক্ষেত্রে জেলা হাসপাতালে ১৫ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৫ শতাংশ পদ শূন্য পাওয়া গেছে।
৪. জেলা হাসপাতালে ৫১ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪২ শতাংশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট/টেকনিশিয়ান পদ শূন্য পাওয়া গেছে।
৫. জেলা হাসপাতালে ২০ শতাংশ ক্লিনার পদ শূন্য থাকলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শূন্য ক্লিনার পদ ৬৬ শতাংশ। জেলা হাসপাতালে ৩১ শতাংশ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫০ শতাংশ নিরাপত্তা প্রহরী বা আনসারের পদ শূন্য পাওয়া গেছে।
চ্যালেঞ্জগুলো :
১. অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ : প্রয়োজনের তুলনায় কম, ছোট, পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ সেবাকক্ষ, অপর্যাপ্ত টয়লেট এবং নিরাপদ পানির অভাব, অনুপযুক্ত হসপিটাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মেডিকেল অফিসার/ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান/সহায়ক কর্মী সংকট, অতিরিক্ত কাজের চাপ, সঠিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য প্রযুক্তির অভাবকে অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিকিৎসকরা চিহ্নিত করেছেন।
২. অন্যায্য সুবিধাভোগীদের প্রভাব ও নিরাপত্তার অভাব সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ : কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ ও প্রস্তাব, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সেবা প্রদানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।
৩. নীতি সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ : উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সুযোগের অভাব, কর্মক্ষেত্রে বদলি বৈষম্য, অর্জিত জ্ঞান বাস্তবায়নে সুযোগের অভাব, বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে বৈষম্য চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ।
৪. পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ : জীর্ণশীর্ণ আবাসন ব্যবস্থা, শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সুবিধার অভাব, দুর্বল যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অবস্থানকে নিরুৎসাহিত করে।
সুপারিশ :
মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সব স্তরের শূন্য পদ পূরণ করা প্রয়োজন।
অর্জিত দক্ষতা অনুযায়ী চিকিৎসকদের যথাযথ পোস্টিং নিশ্চিত করা উচিত। পৃথক পরামর্শ কক্ষ, ওয়েটিং রুম, ডাক্তারের কক্ষ, চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের জন্য পরিষ্কার টয়লেট সুবিধা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের উন্নতি করা প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, রসদ, প্রশিক্ষিত জনবল, ল্যাবরেটরি পরিষেবা উন্নত করা দরকার।
কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীর অ্যাটেনডেন্ট, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি করতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। হাসপাতালের উপযুক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
চিকিৎসকদের জন্য মানসম্মত আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
পোস্টিং, বদলি এবং পদোন্নতির জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োজনীয় সংশোধন করা এবং চিকিৎসকদের পূর্বশর্ত সম্পূর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গে পছন্দসই বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এমআই/এসএসএইচ/