বেসামরিকদের বিক্ষোভ, আন্দোলনের ৩৫ নতুন নির্দেশ জারি বঙ্গবন্ধুর

১৪ মার্চ ১৯৭১। সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের জারি করা ১১৫নং আদেশের বিরুদ্ধে এদিন প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীরা নগরীতে বিক্ষোভ করেন। ফুঁসে ওঠে সারা দেশের মানুষও। বিক্ষোভে যুক্ত হন বেসরকারি কর্মজীবীরা।
অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিক এমপ্লয়িজ অব পাকিস্তানের সমন্বয় কাউন্সিলের সভায় বক্তারা অবিলম্বে সামরিক আইন বাতিলের দাবি জানান। পরে তারা বিক্ষোভ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে তার সঙ্গে দেখা করেন। চলমান অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন তারা এবং অফিস বর্জনের দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
এদিন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রম আরও জোরদার হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন পরিচালনায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি ৩৫টি নতুন নির্দেশ জারি করেন।
এদিন সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান। প্রায় দেড় ঘণ্টার ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামারুজ্জামান। অপরদিকে ন্যাপ নেতার সঙ্গে ছিলেন ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক গাউস বক্স বেজেঞ্জো।
আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জনগণের সার্বিক স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাংলার জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্যবদ্ধ মুক্তিপিপাসু গণমানুষকে পৃথিবীর কোনো শক্তিই দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
বরিশালে জাতীয় লীগ নেতা আতাউর রহমান খান আবারও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অস্থায়ী সরকার গঠনের আহ্বান জানান। এদিন দেশের প্রয়োজনে অস্ত্রধারণ করার ঘোষণা দেন ঝিনাইদহের কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা।
জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৪-দফা পূর্বশর্ত মেনে নেওয়ার দাবিতে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবী সংগঠন এবং যুব মহিলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সভা-সমাবেশ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাতে এক বিবৃতিতে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে নতুন নির্দেশ ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে নির্মূল করা যাবে না। আমরা অজেয়, কারণ আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।
বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে সকালে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে সমাবেশ শেষে মিছিলসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার হাতে একটি আবেদনপত্র দেওয়া হয়। তাতে নেতারা যেকোনো নির্দেশ পালনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে অবিলম্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুরোধ জানান।
এদিন ঢাকার পত্রিকাগুলো ‘আর সময় নেই’/‘Time is Running Out’ শিরোনামে যৌথ সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
করাচিতে নিশাত পার্কে পিপলস পার্টির উদ্যোগে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় পিপিপি’র চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের দুই অংশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তার সঙ্গে সংলাপ শুরু করার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্যবাহী ‘মন্টেসেলো ভিক্টরি’ নামের আরেকটি জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। ‘ওসান এন্ডুরাস’ নামের সমরাস্ত্রবাহী আরেকটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের ১০নং জেটিতে নোঙর করে। বন্দর শ্রমিকদের অসহযোগিতার কারণে ৯ মার্চ ১৬নং জেটিতে সমরাস্ত্রবাহী অপর জাহাজ ‘সোয়াত’-এর সমরাস্ত্র খালাসের চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়।
প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এক বিবৃতিতে ১১ মার্চ খাদ্যবাহী জাহাজ ‘ভিটেজ হরাইজন’ এর গতিপথ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে করাচি বন্দরে পরিবর্তনের ঘটনা সম্পর্কে অবিলম্বে তদন্ত অনুষ্ঠানের দাবি জানান।
স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দেশ থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করে।
এদিকে বাংলার অসহযোগ আন্দোলনে পশ্চিমা শিল্পপতিদের নাভিশ্বাস অবস্থা। তারা সামরিক সরকারকে স্মারকলিপি দেন। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চার দফা মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। হরতালের কারণে ফল চালান করতে না পারায় লাহোরে শত শত মণ ফল নষ্ট হয়ে যায়। করাচিতে প্রতি সের পান ১৫০ টাকা হয়ে যায়। ঢাকার পান না পেয়ে করাচিতে পান বিরল হয়ে পড়ে।
সূত্র : ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চের ইত্তেফাক, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ওয়েবসাইট ও অন্যান্য
এসএসএইচ
