সফল রাষ্ট্রদূত আবিদা হেঁটেছেন আলোকিত পথে

দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার সেতাবগঞ্জ এলাকায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম আবিদা ইসলামের। বাবা প্রয়াত নজরুল ইসলাম প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মা সেলিনা ইসলাম ছিলেন উন্নয়নকর্মী। ঢাকার শহীদ আনোয়ার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি, হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন আবিদা। এরপর অস্ট্রেলিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। পররাষ্ট্র ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচ থেকে ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন আবিদা।
তিনি দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে, বিভিন্ন পদে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। যার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা, দূরপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আমেরিকা-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগ। আবিদা দায়িত্ব পালন করেন লন্ডন, কলম্বো ও ব্রাসেলসে বাংলাদেশ মিশনে। তিনি কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে প্রথম নারী ডেপুটি হাইকমিশনার (হেড অব মিশন) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষ ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকা উইংয়ে দেড় বছর কর্মরত থাকার পর ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ায় লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। ব্যক্তিজীবনে দুই সন্তান; আরশাদ আহমেদ, আয়েশা আহমেদের জননী আবিদা। নারী দিবসে (৮ মার্চ) এ কূটনীতিক কথা বলেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওমর ফারুক হিমেল-
সমাজে নারীর অবস্থান কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অর্থনৈতিক বঞ্চনা এখনও রয়ে গেছে। কিছুটা সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও অসমতা এবং অর্থনৈতিক বঞ্চনা কমেনি। যেমন- কাজের ক্ষেত্রে সমান মজুরি নিশ্চিত না করা, সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা না করা। ঘরে-বাইরে নারীরা সহিংসতা, যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, যা করোনাকালে আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ১৯১০ সালের ৮ মার্চ প্রথম নারী দিবস পালিত হয়েছিল। ১১০ বছর পরও আমরা নারী দিবস পালন করছি। হয়তো এমনিভাবে আরও অনেক বছর লাগবে নারীদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে।
নারী ও শিশু নির্যাতনকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। যেমন- নারী শিক্ষার বিস্তার, দারিদ্র্য বিমোচন, বাল্যবিবাহ রোধ, নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় কর্মসূচি। এছাড়া নারীর অধিকার রক্ষায় সরকার বিভিন্ন আইন করেছে। সেইসঙ্গে মাতৃত্বকালীন ভাতা, ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা কার্যক্রমসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে চলেছে।
নারীরা নানা বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন, একে কীভাবে দেখেন?
প্রতিবন্ধকতা নারীদের জন্য নতুন কিছু নয়। সেই আদিকাল থেকেই সবসময় বৈষম্যের শিকার হয়েছে নারী। বঞ্চনার শিকার হয়েছে এবং এখনও চলছে এসব। নানা প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা জয় করেই নারী এগিয়ে গেছে এবং আজও এগিয়ে যাচ্ছে।
সভ্যতায় নারীর অবদানকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
সমাজ-সভ্যতা এগিয়ে নিতে নারী সবসময় অবদান রেখেছে। এ যুগে নারীকে পরিবার ও কর্মস্থল দুদিকই সামলাতে হয়, সমানভাবে নজর দিতে হয়। আগে যখন গৃহস্থালির কাজে বন্দি ছিল, তখন নারীর দায়িত্ব এবং কর্তব্য সংসারের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কর্মস্থলে এসে নারীর দায়িত্ব-কর্তব্য দ্বিগুণ হয়েছে। নারীরা এখন ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, কূটনীতি, সশস্ত্র বাহিনী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী, শান্তিরক্ষা মিশনসহ সর্বক্ষেত্রে সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
কূটনৈতিক পেশায় আছেন দীর্ঘদিন। এ পেশায় নারীর পদচারণা কেমন?
পঁচিশ বছর আগে এই পেশায় যোগ দেই। তখন নারী কূটনীতিক সংখ্যায় ছিল খুবই কম। শুনেছি আমাদের আগে অনেক নারীই এই পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের সমর্থনের অভাবে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। এখন অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এ পেশায় নারীর সংখ্যা বাড়ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশের প্রথম নারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে আপনার অনুভূতি কী?
রাষ্ট্রদূত রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, তিনি নারী না পুরুষ সেভাবে কখনও ভেবে দেখিনি। সেভাবে ভাবা সমীচীন নয়। আমি সব সময় নিজেকে বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মকর্তা হিসেবে ভেবেছি। যাকে সরকার সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে। নারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমার আলাদা করে কোনো অনুভূতি নেই।

দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও এর মূল্যায়ন?
নারীর ক্ষমতায়নে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীন করার পর দেশ পুনর্গঠনে নারীদের সম্পৃক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানে এবং রাষ্ট্রীয় নানা আইনের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
নারীকে অবহেলা করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব?
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এই জনগোষ্ঠীকে অর্থনীতির মূল ধারার বাইরে রেখে দেশের টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।
বর্তমান কর্মপরিবেশে সহকর্মীরা কতটুকু সহায়ক?
বর্তমান কর্মপরিবেশ অত্যন্ত অনুকূল। নারী হিসেবে আমি কোনো বৈষম্যের শিকার হইনি। আমার যে সহকর্মীরা ছিলেন এবং আছেন, তারা সব সময় অত্যন্ত আন্তরিক। পরিবার থেকেও সব সহযোগিতা পেয়েছি। সুতরাং, সেদিক থেকে আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী।
পরিবার ও কর্মস্থলে পুরুষের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
পরিবার ও কর্মস্থলে এখনও পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়ে গেছে, যা পরিবর্তন করতে হবে। নারীদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নারীর প্রতি যথাযথ মর্যাদা এবং সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। তাছাড়া পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব সম্পদে নারী এবং পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে। নারী-পুরুষের অধিকারের সমতা প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি মনে করি।
আইন করে, শাস্তি দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করা যাচ্ছে না। বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রয়োজন মানসিক পরিবর্তন। নারীদের সম্মান ও যথাযথ মর্যাদা দিতে শিশুকাল থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
আপনার ২৫ বছরের কূটনীতিক জীবনের স্মরণীয় কোনো স্মৃতি।
আমার বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমার পদায়ন নিশ্চিত হলে বাবা বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে কর্মরত তার সহকর্মীদের জানান। তারা তখন বাবাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমি যেন এ চাকরি বাদ দিয়ে অন্য কিছু করি (স্কুল বা কলেজের শিক্ষকতা)। অথবা সরকারের অন্য কোনো ক্যাডারে যোগদান করি। কারণ, পরিবার সামলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ খুবই কষ্টকর হবে। আমার মা মুক্তমনের মানুষ ছিলেন এবং তিনি সে সময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি কাজে যোগ দিতে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, চেষ্টা করে দেখতে, সফল না হলে অন্যকিছু ভাবা যাবে। তখন পরিবারের এ সহযোগিতা না পেলে আমার জীবন হয়তো অন্যরকম হতো।
আপনাকে ধন্যবাদ।
নারী স্ব-মহিমায় জেগে উঠুক সারাবিশ্বে। ঢাকা পোস্টকে ধন্যবাদ।
এইচকে