দুর্ঘটনা বাড়লেও বিধিমালায় উপেক্ষিত ‘সড়কের নিরাপত্তা’

দেশে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। সিআইপিআরবি এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছর ২৩ হাজার ১৬৬ জন সড়ক দুর্ঘটনায় (রোড ক্রাশ) নিহত হয়।
এদিকে, সম্প্রতি জারি করা সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃত সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কারণ ১৬৭টি বিধির মধ্যে মাত্র পাঁচটি বিধিতে সড়কের নিরাপত্তার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বাকীগুলোতে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এই বিধিমালার আওতায় সড়কের নিরাপত্তা বিধান সম্ভব নয় বলে মনে করে বক্তারা।
বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ডেইলি স্টার ভবনের শহীদ আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে আয়োজিত ‘হাই-লেভেল ডায়ালগ অন রোড ট্রান্সপোর্ট অ্যাক্ট-২০১৮ অ্যান্ড রোড ট্রান্সপোর্ট রুলস-২০২২ : রোল অব মিডিয়া’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা এসব মন্তব্য করেন।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. খন্দকার আব্দুল আওয়াল রিজভীর সভাপতিত্বে এবং টিভি টুডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুলের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোড সেইফটি অ্যান্ড ইনজুরি প্রিভেনশন প্রোগ্রামের ডা. মাহফুজুর রহমান ভূঁঞা।
ডা. মাহফুজ বলেন, সরকার ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন জারি করেন এবং দীর্ঘ চারবছর পরে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সড়ক পরিবহন বিধিমালা প্রণয়ন করেন। কিন্তু এই বিধিমালায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃত সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং বিধিমালায় সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দেশে প্রতিবছর ২৩ হাজার ১৬৬ জন সড়ক দুর্ঘটনায় (রোড ক্রাশ) নিহত হয় বলে সিআইপিআরবি এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অকাল মৃত্যু রোধ করতে জাতিসংঘের সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেইফটি ২০২১-২০৩০ এ বর্ণিত পাঁচটি স্তম্ভ (নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা) কাজে লাগানো হলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার হ্রাস পায় ও দীর্ঘমেয়াদী পঙ্গুত্ব থেকে মানুষকে রক্ষা করা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই স্তম্ভগুলো কাজে লাগিয়ে মৃত্যু হার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
মাহফুজুর রহমান বলেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত ৫টি আচরণগত ঝুঁকির (গতি কমানো, সিটবেল্ট ব্যবহার, সঠিক হেলমেট ব্যবহার, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি না চালানো এবং শিশুদের জন্য বিশেষ সিটের ব্যবস্থা) ওপরেও নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে জানান ডা. রহমান।
সংলাপে সভাপতির বক্তব্যে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. খন্দকার আব্দুল আওয়াল রিজভী বলেন, সড়ক পরিবহন বিধিমালায় সড়কের নিরাপত্তার বিষয়টি অল্প পরিমাণে উল্লেখ করা হলেও সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে। তাই সড়ককে নিরাপদ করতে গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ; সঠিকভাবে সিটবেল্ট পরিধান; গুনগত হেলমেটের ব্যবহার নিশ্চিত করা; দুর্ঘটনা পরবর্তী আহত ব্যক্তির যথাযথ চিকিৎসা এবং পুর্নবাসন সংক্রান্ত ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা কমছে, কিন্তু আমাদের দেশে উল্টো হচ্ছে। কমছে না বরং বাড়ছে। মৃত্যু নিয়ে নানা পরিসংখ্যান আছে, তবে এটাকে আমরা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছি না। দুর্ঘটনায় প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক। আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাই।
ডা. রিজভী বলেন, দুর্ঘটনা কমাতে হলে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হবে, ম্যানেজমেন্টে গুরুত্ব দিতে হবে। হংক ম্যানেজমেন্টে ভালো করেছে, তাদের সক্ষমতা তো আমাদের চেয়ে বেশি না। ম্যানেজমেন্টকে দায়িত্ব ও ক্ষমতা দিতে হবে। আমাদের সিগনাল লাইট আছে, কিন্তু আমরা চালাতে পাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের প্রতিটি সিগনালেই ১০/১২ জন ট্রাফিক পুলিশ থাকে, কিন্তু সিগনাল লাইটগুলো পরিচালনা একজনের মাধ্যমেই সম্ভব। খুব সুন্দর করেই হংকং পরিচালনা করছে।
তিনি আরও বলেন, সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সচেতনতায় সরকারের কোনও বরাদ্দ নাই। অথচ কতো কতো অপচয় হচ্ছে। ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় ভালো আইল্যান্ড ভেঙে নতুন করে করছে, এগুলোতে অনেক অনেক টাকা অপচয় করছে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অর্থপেডিক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোনায়েম হোসেন, মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম ও গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের রোড সেইফটি প্রোগ্রামের ক্যান্ট্রি কো-অরডিনেটর ড. মো. শরিফুল আলম।
সংলাপে প্যানেল আলোচক হিসেবে ছিলেন দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম-বার্তা সম্পাদক সোহরাব হোসেন, বাংলাভিশনের জ্যৈষ্ঠ বার্তা সম্পাদক আবু রুশ মো. রুহুল আমীন, নাগরিক টিভির প্রধান প্রতিবেদক শাহনাজ শারমিন ও দৈনিক ইত্তেফাকের মাইনুল হোসেন প্রমুখ।
টিআই/এসএম