সালেহীন দেশে নেই, ‘ট্রেস আউট’ ছিনিয়ে নেওয়া শামীম-সোহেলও

Md Jasim Uddin

০৪ মার্চ ২০২৩, ০৮:০৮ পিএম


সালেহীন দেশে নেই, ‘ট্রেস আউট’ ছিনিয়ে নেওয়া শামীম-সোহেলও

বাংলাদেশে প্রথম জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ময়মনসিংহে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে জেএমবির শীর্ষ তিন নেতাকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তাদের একজন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি সালাউদ্দিন সালেহীন। যিনি ৯ বছর ধরে পলাতক আছেন। এদিকে কিছুদিন আগে ঢাকায় আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি শামীম ও সোহেলও ‘ট্রেস আউট’ (লাপাত্তা)।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সালাউদ্দিন সালেহীন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আত্মগোপন করেছেন। তবে আদালতপাড়া থেকে ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি কোথায় আছে তা কেউ জানে না। তারা দেশে নাকি দেশের বাইরে আছে তা নিশ্চিত হতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

আরো পড়ুন >> জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়া অবশ্যই আমাদের ব্যর্থতা : র‌্যাব মহাপরিচাল

জঙ্গি ছিনতাই ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসি কর্মকর্তাদের দাবি, শামীম ও সোহেলের অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। তাদের ধারণা, দেশ থেকে দুজন পালাতে পারেনি। তাদেরকে কারা, কীভাবে, কয়জনের উপস্থিতিতে, কাদের নির্দেশে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে জঙ্গি দমনে তৎপর থাকা।

২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে রাকিব হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাসেল, সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তৌহিদ এবং মিজান ওরফে বোমা মিজান ওরফে জাহিদুল হাসান সুমনকে ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় সকাল আটটার দিকে ময়মনসিংহের আদালতে হাজির করার জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। ত্রিশাল ও ভালুকার মাঝামাঝি সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশের ওই প্রিজন ভ্যানে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ওই তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয় অন্য জঙ্গিরা। এসময় এক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়।

dhakapost

ছিনিয়ে নেওয়া তিন জঙ্গির মধ্যে জেএমবির মজলিসে শূরা সদস্য সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন ও হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এবং বোমা মিজান ছিলেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামি।

বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাহমুদ, ভারতে গ্রেপ্তার বোমা মিজান, লাপাত্তা সালেহীন

ছিনতাই হওয়ার দিন বিকেলে জঙ্গি নেতা হাফেজ মাহমুদকে টাঙ্গাইলের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। রাতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন তিনি। এর কয়েক মাস পর ভারতে গ্রেপ্তার হন বোমা মিজান।

২০১৪ সালের ২ অক্টোবর ভারতের বর্ধমানের খাগড়াগড়ের একটি বাড়িতে বিস্ফোরণে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনায় জেএমবির সংশ্লিষ্টতা পায় ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ। বিহারের বুদ্ধ গয়া বোমা বিস্ফোরণের মামলায়ও খোঁজা হচ্ছিল বোমারু মিজানকে।

আরো পড়ুন >> জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার মিশনে অংশ নেয় ১৭-১৮ জন

ভারতের আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ), বিস্ফোরক আইন ও বিদেশ আইনের মোট সাতটি ধারায় অভিযোগ আনা হয় মিজানের বিরুদ্ধে। তিনি আদালতে দোষ স্বীকার করায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাঁচটি ধারায় বিচারক পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেন। আর দুটি ধারায় দেওয়া হয় দুই বছর করে সাজা। সবমিলিয়ে ২৯ বছর জেল খাটতে হবে এই জঙ্গিকে। 

জঙ্গি মাহমুদ নিহত এবং বোমারু মিজন গ্রেপ্তার হলেও অধরা রয়েছেন সালাউদ্দিন সালেহীন। জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন শূরা সদস্য সালেহীনকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছে বাংলাদেশ পুলিশ। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ’র ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায়ও রয়েছেন তিনি।

ঢাকার আদালতপাড়া থেকে ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি এখনো লাপাত্তা

ত্রিশালের ঘটনার ৯ বছর পর গত বছরের ২০ নভেম্বর দিনে-দুপুরে ফিল্মি স্টাইলে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে খোদ রাজধানী ঢাকায়। ওইদিন পুরান ঢাকার সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালে শুনানি শেষে সিএমএম আদালতের হাজতখানায় নেওয়ার পথে হামলা করে জঙ্গিরা। তারা দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যের চোখে স্প্রে করে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়। ছিনিয়ে নেওয়া দুজন হলো আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীম।

এ দুই জঙ্গি ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে জঙ্গিদের হাতে নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও ব্লগার অভিজিত রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এখন পর্যন্ত তদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে সালেহীনের মতো তাদেরকে ধরিয়ে দিতেও ২০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে পুলিশ।

পালানোর পর সেই দুই আসামিসহ অন্য আসামিদের কেন ডান্ডাবেড়ি ছাড়া আদালতে নেওয়া হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দুই পলাতক জঙ্গি গ্রেপ্তার না হওয়াটাকে ‘অশনি সংকেত’ বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

dhakapost

আগে পালানো সালেহীনের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটিটিসির ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাহমুদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সালেহীন এখন পর্যন্ত পলাতক। তিনি কোথায় আছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে আমাদের ইনটেলিজেন্স (গোয়েন্দা) তথ্য অনুযায়ী সালেহীন ভারতে আত্মগোপনে আছেন।

আরো পড়ুন >> ‘রেকি’ করে চাবি ও অ্যান্টিকাটার নিয়ে এসেছিল জঙ্গিরা

ঢাকার আদালাতপাড়া থেকে পালানো দুই জঙ্গির অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, আদালতপাড়া থেকে পালানো দুজনের সঙ্গে কিছু কানেকশন আমরা পেয়েছি। তবে তাদের হদিস এখনো আমরা পাইনি। তারা কোথায়, কীভাবে গেছেন, কারা তাদের সহযোগিতা করে নিয়ে গেছে সেসব ব্যাপারে আমরা তথ্য পেয়েছি। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।

পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (অপারেশন) মনিরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের যতটুকু তথ্য আছে তাতে বলা যায় সালাহউদ্দিন সালেহীন ভারতে রয়েছে। আমরা ভারতে গিয়েছিলাম। এনআইএ ও আমাদের ধারণা সালেহীন ভারতের কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। একসময় সে বর্ধমানের দিকে ফলমূল বিক্রি করেছে। আমাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই সালেহীনের কয়েকজন সহযোগী ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছে। সালেহীন বাংলাদেশে এসেছে কি না এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।

ঢাকার আদালতপাড়া থেকে ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত তারা দেশের বাইরে চলে গেছে, সেরকম তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ ব্যাপারে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত করছে সিটিটিসি। তারা এ সংক্রান্ত আরও তথ্য দিতে পারবে।

ঢাকার আদালাতপাড়া থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্ত করছে সিটিটিসির কাউন্টার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। এ বিভাগের উপ-কমিশনার নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিতে একাধিক সদস্যের অংশগ্রহণ ছিল। আমরা দুজনকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা করছি। তাদের টার্গেট ছিল দেশ ছাড়ার। তবে তাদের অবস্থান আমরা এখনো নিশ্চিত নই। তারা দেশে আছে নাকি বর্ডার ক্রস করে ফেলেছে তা জানা যায়নি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে জঙ্গি দমনে তৎপর থাকা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক আবদুর রব খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কীভাবে জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়া যায় সে চিত্র আমরা দেখেছি। এখন তাদের ধরে ফেলা জরুরি। কারণ, কখন কোথায় তারা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে কিংবা মানুষের জানমালের ক্ষতির কারণ হবে সেটা বলা যায় না। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশকে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

জেইউ/জেডএস

Link copied