বৃদ্ধাশ্রমে একদিন
জীবন যেখানে অন্য নিয়মে চলে

ছবি : নূরে আলম নীয়াশ
জানুয়ারির কোনো এক বৃহস্পতিবারের মিটিংয়ে আলোচনা চলছে। বিষয়: ১৪ ফেব্রুয়ারি কী করা যায়? আচঁল আর গোধুলি বলে উঠল, চলো ফুল বিক্রি করি। কাপলদের ছবি তুলে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে খাওয়ার প্রস্তাবও আসে। সবাই হাসিতে মেতে ওঠে এ প্রস্তাবে। মাঝে কেউ একজন বলে ওঠে, চলো সবাই মিলে বৃদ্ধাশ্রম যাই। হঠাৎ করে মিটিংয়ে পিনপতন নীরবতা।
ব্যাস সেইদিনই ঠিক হয়ে যায় বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ‘টিম ইউথ’ সময় কাটাবে একটি বৃদ্ধাশ্রমে। একমুঠো ভালোবাসা সকলের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার আশায় আমরা বেরিয়ে যাই সঠিক বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজে এবং পেয়েও গেলাম মনের মতো। ঢাকার অনতিদূরে কাপাসিয়া উপজেলায় ‘আব্দুল আলী সেবাশ্রম’ নামের একটি বৃদ্ধাশ্রম নির্বাচন করি সবাই মিলে। এরপর সেই বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশ দেখে এবং সেখানকার ম্যানেজারের সাথে বৃদ্ধাশ্রমের যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি জানান তাদের বৃদ্ধাশ্রমের ওষুধের ঘাটতির কথা এবং বৃদ্ধাশ্রম সংলগ্ন গড়ে ওঠা হাসপাতালের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।

সেদিন রাতেই সবাইকে বৃদ্ধাশ্রমের ব্যাপারে সবকিছু জানিয়ে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ঠিক হয় ১৪ তারিখ আমরা সেখানে গিয়ে সবার সাথে মধ্যাহ্নভোজ করব, আড্ডা দেবো সারাদিন। দিনশেষে তাদের ওষুধগুলো সরবরাহ করব এবং নির্মাণাধীন হাসপাতালের কাজ সচল রাখার জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদানের চেষ্টা করব।
এরপর সবাই মিলে ইভেন্টের নাম নির্বাচন করা হয় ও কাজ ভাগ করে নেওয়া হয়।
তারপর শুরু হয় ফান্ড কালেকশনের কাজ, জিদান বৃদ্ধাশ্রমের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবস্থা করলেন, বাঁধন ব্যস্ত হলেন ইভেন্টের ব্যানার তৈরির কাজে। এরপরে ইভেন্টের আগের দিন ওখানে মধ্যাহ্নভোজ করার মতো খাবার তৈরির জন্য কাঁচা শাক-সবজি, মুরগি এবং প্রয়োজনীয় সব উপকরণ আঁচল, গোধুলি এবং শিফার হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। সাথে সাথে রান্নার কাজ শুরু করে দেন ওরা তিনজন।

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। ঘড়িতে তখন সকাল ৭টা। বৃদ্ধাশ্রমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা পাঁচজনের। গাড়ির পেছনের ডিকিতে মধ্যাহ্নভোজের খাবার রাখা হয়। আনুমানিক তিন ঘণ্টা সফরের পর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছায় ‘টিম ইয়ুথ।’ অল্প কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার পর ১২টার দিকে সবাই ব্যস্ত হয়ে যায়। গোধুলি খাবার গরম করতে থাকেন, আঁচল এবং জিদান বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের সাথে আড্ডায় মশগুল হয়ে যান, শিফা এবং বাঁধন ঘুরে দেখেন পুরো বৃদ্ধাশ্রম।
জিদান ও আচঁল পুরো বৃদ্ধাশ্রমটা ঘুরে দেখছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে একজন মধ্যবয়সী বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা আঁচলের পরিহিত মখমলের কাপড় দেখে বলেন, আমরাও তরুণী বয়সে হাতাকাটা মখমলের ব্লাউজ পরতাম, এখন আর এগুলো কেউ পরে না। তোমাকে দেখে পুরোনো দিনের সেই সোনালী দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। আহারে জীবন! তার সাথে আরও কথা বলে জানতে পারা যায় যে, তিনি একবছর ধরে এই বৃদ্ধাশ্রমে আছেন এবং তার চোখের অপারেশন করিয়ে দিয়েছেন অভিনেতা ওমর সানি।
শিফা-বাঁধন বৃদ্ধাশ্রমের আরেকজন পুরোনো সদস্যের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটান। তারা জানতে পারেন তিনি মাস্টার্স পাস করেছেন পাকিস্তানি শাসনামলে এবং একটি বিখ্যাত স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা তার জীবন বদলে দেয়, তিনি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পায়ের ফিমার, বুকের পাঁজর এবং কবজিতে গুরুতর আঘাত পান। তিনি তার সন্তানদের বোঝা হতে চাননি, তাই তিনি এখন বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটাচ্ছেন। হাতে-পায়ে এখনও ব্যাথা অনুভব করেন বলেও জানান তিনি। শেফা এবং বাঁধন তাকে আশ্বাস দেন এই বলে যে, টিম ইয়ুথের পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে এসেছি।

তারপর জিদান আর আঁচল বৃদ্ধাশ্রমের ১০১ নম্বর রুমে থাকা একজন প্রবীণের কাছে তার সম্পর্কে জানতে চান। এই প্রবীণ প্রথমেই তাদের বৃদ্ধাশ্রমে থাকা কুকুরটি থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেন। এরপর তিনি তার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু গল্প শুনিয়েছেন এবং সবসময় বাস্তববাদী হতে উপদেশ দিয়েছেন।
তিনি ক্রিকেট খেলা দেখতে পছন্দ করেন এবং এফএম রেডিওতে খেলার ধারাভাষ্য শোনা তার নিয়মিত অভ্যাস। তিনি একজন সরকারি কর্মকতা ছিলেন এবং ভ্রমণপিপাসু ছিলেন, তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে তার ঠিকানা আজ বৃদ্ধাশ্রম।
বৃদ্ধাশ্রমে রান্নার কাজে নিয়োজিত একজনের কাছ থেকে জানা যায় তিনি স্বেচ্ছায় এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন এবং তিনি তার জীবনের গল্প বলেন। তিনি দুই মেয়ের মা এবং মেয়েদের বিয়ের পরই তার স্বামী মারা যান, ফলে তিনি একা হয়ে যান এবং বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসেন। রান্নাবান্না করে সবার সাথে মিলেমিশে থেকে সারাজীবন পার করে দেওয়ার পরিকল্পনা তার।
দুপুর ২টা। খাবারের ব্যবস্থা করা হলো সকলের জন্য। সবাই একসাথে খাবার খাওয়ার সময় জমে ওঠে এক মজার আড্ডার আসর। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা সকলেই তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট গল্প বলতে থাকেন এবং উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেন ‘টিম ইউথ’-এর সকল সদস্যকে।

বিকেল ৪টা। মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে ‘টিম ইউথ’ এবং বৃদ্ধাশ্রমের সকলে। জিদান এবং আঁচল ১২৬ নম্বর কক্ষের সামনে বসে নচিকেতা চক্রবর্তীর ‘বৃদ্ধাশ্রম’ গানটি গাইতে থাকা একজন বৃদ্ধার সাথে পুরো বিকেলটা কাটিয়ে দেন। তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জীবনমুখী কথা বলেন। তার জীবনের কষ্টের দিনগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলেন। তিনি আঁচলকে বলেন, বিয়েতে আমি এখন আর বিশ্বাস করি না, মা, তুই পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবি, নিজের ক্ষমতা দিয়ে জীবন চলার পথে যেকোনো বাধা অতিক্রম করবি। আর মা শোন, বাবা-মাকে অনেক যত্ন করিস, তারাই তোর সম্বল।
ধীরে ধীরে বিদায়বেলা ঘনিয়ে আসে। বৃদ্ধাশ্রমের জন্য নিয়ে আসা ওষুধ এবং আর্থিক সাহায্য ম্যানেজারের হাতে তুলে দিয়ে সকলের কাছে থেকে একে একে বিদায় নেয় ইউথের সকল সদস্য। এবং সবশেষে গাড়িতে উঠে নিজেদের ভবিষ্যতের অবশ্যম্ভাবী পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে থাকে টিম ইউথের সবাই। এভাবেই একসময় সূর্যের মতো দিগন্তরেখার সাথে হারিয়ে যায় টিম ইউথের সন্ধ্যার আকাশে।