মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি প্রায় ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু এখনো আমরা তরুণদের মধ্যে সেই ধরনের জাগরণ তৈরি করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা রাষ্ট্রীয়ভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তা না হলে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে যে শপথ আমরা নিয়েছিলাম, তা অর্জিত হবে না।
সোমবার (১৭ এপ্রিল) রাজধানীর প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরাম খাঁ মিলনায়তনে ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উপলক্ষ্যে সম্প্রীতি বাংলাদেশের আয়োজিত ‘অবিস্মরণীয় এক দিন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
এ সময় বক্তারা বলেন, ‘বাঙ্গালি জাতির জীবনে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব অপরিসীম। সেদিন সেখানে অনেক বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। সব সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাজিত করে আমাদের দেশ গঠিত হয়েছে। সেসময় বিদেশি সাংবাদিকদের কারণে মুজিবনগর সরকারের ব্যাপক প্রচার হয়েছিল। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। আমরা আজকে জামায়াত শিবিরের চক্রান্তের কথা বলি। কিন্তু তৎকালীন তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার লোকও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। আওয়ামী লীগের ভেতরেও এরকম লোক অনেক আছে, আমাদের সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।’
বক্তারা আরও বলেন, ‘যারা জন্মসনদকে স্বীকার করে না, তারা এদেশের সন্তান হয় কীভাবে? তারা বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারে কীভাবে? এই প্রশ্নের সমাধান হওয়া দরকার। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র চলছে। যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।’
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘মুজিবনগর সরকারের কথা বলতে গেলে ৭ মার্চের কথা আসবে। সেই ৭ মার্চের স্বাধীনতার ডাক পৌঁছে গিয়েছিল তখনকার অজপাড়াগাঁয়ে মেহেরপুরে। সেকারণেই আজকের ১৭ এপ্রিল। মার্চের ৩০ তারিখ থেকে ১৭ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত দেশের মুক্তিকামী মানুষের কোনো প্রকার স্বীকৃতি ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বে যখন দুর্ভিক্ষ শুরু হয় তখন এক ধরনের শ্রেণিবৈষম্য তৈরি হয়। আমাদের দেশেও এক ধরনের শ্রেণিভেদ তৈরি হয়েছে। যেই শ্রেণিভেদের কারণে আমাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এর ফলে নানা ধরনের অশান্তিও তৈরি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় গুন ছিল তিনি মানুষকে খুব তারাতাড়ি কাছে নিতেন। এটা তার কোনও রাজনৈতিক কৌশল ছিল না। স্বপ্রণোদিত হয়ে সে মানুষকে কাছে নিতেন। আমি মনে করি আমরাও যদি মানুষের কাছে থাকি তাহলে আমরা মানুষের সমস্যা এবং সুখ-দুঃখকে ভালো করে বুঝতে পারবো। তখনই কিন্তু এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ আজকে যে পর্যায় এসেছে তার জন্য অনেকেই যেমন বাংলাদেশের প্রশংসা করছেন তেমনি দুর্নামও করছেন অনেক দেশ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমারা প্রচুর রক্তচক্ষু দেখিয়েছিলো। কিন্তু আমরা আমাদের নৈতিকতা, উৎসাহ ও উদ্দীপনা দ্বারা সে সমস্ত রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জয় নিয়ে এসেছি।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসার ধারাবাহিকতায় আমরা একটি সমাজ গড়ে তুলবো, যে সমাজে সবাই সুযোগ পাবে এবং আমরা পুরোপুরি দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারবো। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এগুলো জানাতে হবে। পাশাপাশি তাদের ইতিহাস সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের নতুন প্রজন্মকে বুঝতে হবে। আমাদের অনেক ব্যর্থতা রয়েছে। তবে চেষ্টা সব সময় অব্যাহত রয়েছে। এ চেষ্টা যদি নতুন প্রজন্ম অব্যাহত রাখে। আমরা সবাই মিলে-মিশে যদি দেশটাকে সামনে নিয়ে যেতে চাই, অনেক অর্জন আমাদের পক্ষে সম্ভব।’
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সম্প্রীতি বাংলাদেশর আহ্বায়ক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বিদেশি সাংবাদিক ও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যক্তিদের কলকাতা থেকে আসার জন্য ৪০টি গাড়ি ব্যবহৃত হয়। যে গাড়িগুলোর ব্যবস্থা করেছিলেন নিহার চক্রবর্তী। তিনি সাংবাদিক বা রাজনৈতিক ব্যক্তি কেউই নন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি কাজ করে গেছেন। এই ৪০টি গাড়ি যাদের কাছ থেকে তিনি নিয়েছিলেন তাদের তিনি বলেছিলেন ‘দয়া করে ট্যাংকি ভরে তেল দিও যেন সারাদিন গাড়িটি চলতে পারে’। ১৬ এপ্রিল রাতে কলকাতা প্রেসক্লাবে এই গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। অথচ আজ পর্যন্ত আমরা তাকে স্বীকৃতি দিতে পারিনি।
আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার, মুজিবনগরে গার্ড অব অনার প্রদানকারী মাহবুব উদ্দীন আহমেদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. রাশিদ আফসারী ও সিনিয়র সাংবাদিক শোয়েব চৌধুরী সহ প্রমুখ ব্যক্তিরা।
এসএম