নিরাপত্তাহীনতায় অতিরিক্ত সচিব ও স্ত্রী, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে জিডি

স্ত্রী নাজমুন নাহার ও নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে রাজধানীর ভাটারা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন। মঙ্গলবার (২৩ মে) রাতে দায়ের করা তার সাধারণ ডায়েরি নম্বর ২১৪৩।
জিডিতে তোফাজ্জেল হোসেন উল্লেখ করেছেন রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকার বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাজ্জাদুর রহমানের কিছু পদক্ষেপ ও আচার-অচরণের কারণে তাঁর স্ত্রী ও তিনি নিজে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তিনি আশঙ্কা করছেন অধ্যক্ষ সাজ্জাদ তাদের বড় ধরনের ক্ষতি করবেন।
অতিরিক্ত সচিব তোফাজ্জেলের স্ত্রী নাজমুন নাহার বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক (ব্যবস্থাপনা) এবং গভর্নিং বডির নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি।
যোগাযোগ করা হলে অতিরিক্ত সচিব তোফাজ্জেল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার জীবনে আমি অধ্যক্ষ সাজ্জাদুর রহমানের মতো এমন চতুর ব্যক্তি আর দেখিনি, তিনি অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় মানুষের ক্ষতি করতে পারেন। তিনি ভবিষ্যতে আমার স্ত্রীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন এমন আশঙ্কা থেকে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও কাল্পনিক অভিযোগ তুলছেন এবং নানাভাবে হয়রানি করছেন।
তিনি বলেন, গত সোমবার (২২ মে) বিয়াম থেকে আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অধ্যক্ষ সাজ্জাদুর রহমানের একটি অভিযোগের ফটোকপি পেয়ে আমরা অবাক হয়ে যাই। ঐ অভিযোগে মিথ্যাচার, আক্রোশমূলক ভাষা দেখে আমাদের মনে হয়েছে, সাজ্জাদুর রহমান ঠান্ডা মাথায় যে কাউকে দিয়ে শুধু চাকরির ক্ষতিই নয়, আমার ও আমার স্ত্রী নাজমুন নাহারের জীবননাশের চেষ্টাও করতে পারেন। তাই জীবননাশের আশঙ্কা থেকে আমি সাধারণ ডায়েরি করেছি।
জানতে চাইলে বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাজ্জাদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই। ওনার মনে হয়েছে জিডি করেছেন।’
এ বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করেও ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জিডিতে তোফাজ্জেল হোসেন যা যা উল্লেখ করেছেন
আমার স্ত্রী নাজমুন নাহার ২০০৬ সাল থেকে বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সততা, দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে সুনামের সঙ্গে অধ্যাপনা করছেন। এটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিয়াম ফাউন্ডেশনের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলেও এটি কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়।
বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ সাজ্জাদুর রহমান ২০২১ সালে যোগদান করেন। তিনি আমার স্ত্রীকে স্কুলের বেশ কয়েকটি কমিটির কাজ দেন। আমার স্ত্রী নাজমুন নাহার বিবিএ ও এমবিএ ডিগ্রিধারী। তার অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট ভাল এবং তিনি এক্সট্রা কারিকুলামেও দক্ষ।
অধ্যক্ষ সাজ্জাদুর রহমান যোগদানের কয়েক মাস পর স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হাসিনা মজুমদারের কয়েকটি দুর্নীতির তথ্য প্রমাণসহ বিয়াম ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। বিয়াম কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সততা, নিষ্ঠা, নিরপেক্ষতা ও দক্ষতা বিবেচনা করে বিয়াম ফাউন্ডেশন আমার স্ত্রী নাজমুন নাহারকে এ কমিটির সদস্য করেন।
বিগত কয়েক মাস আগে আমার স্ত্রী নাজমুন নাহারকে ক্রয় কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে অধ্যক্ষের গাড়ির যন্ত্রাংশ ক্রয়ের ভাউচার এবং অপর একটি গাড়ির লগ বইয়ে স্বাক্ষর করতে বলেন অধ্যক্ষ সাজ্জাদ। তিনি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন এবং তার সরাসরি দায়িত্ব নয় বলে যাচাই করে দেখতে সময় নিচ্ছিলেন। এতে অধ্যক্ষ তার ওপর ক্ষিপ্ত হন। এছাড়া নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নিং বডির একটি সভায় তিনি বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য আত্মসমালোচনা করেন। এতেও অধ্যক্ষ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হন এবং শিক্ষকদের নিয়ে সভা করে আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। তিনি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করেন। যথার্থতা যাচাই না করে বিল ভাউচার, লগবই স্বাক্ষর করার চেয়ে আমার স্ত্রী নাজমুন নাহার সব কমিটি থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করেন।
আমার জানামতে, আমার স্ত্রী সকল কমিটি থেকে তাকে বাদ দেওয়ার জন্য অধ্যক্ষকে মৌখিকভাবে অনুরোধ করলে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। কিছুদিন পর আমার স্ত্রী খেয়াল করে দেখেন, সাজ্জাদুর রহমান (অধ্যক্ষ) তার সাধারণ কোনো ভুলকেও অপরাধ হিসেবে দেখছেন।
এ বছর জানুয়ারি মাস থেকে অধ্যক্ষ সাজ্জাদুর রহমান ১১টায় স্কুল ও কলেজ শুরুর পরিবর্তে শিক্ষকদের হাজিরার শেষ সময় সকাল সাড়ে ৭টা এবং সকাল ৮ টায় ক্লাস শুরুর নিয়ম চালু করেন। ঐ সময় আমরা স্বামী-স্ত্রী খুব ভোরে ১১ তলা থেকে হেঁটে নেমে কুয়াশার মাঝে রওনা হতাম এবং ২/১ দিন ছাড়া আমার স্ত্রী প্রতিদিনই যথাসময়ে কলেজে হাজিরা দিয়েছেন।
জানুয়ারি মাসের শীতের কোনো একদিন স্ত্রীকে কলেজে নামিয়ে আমি যথারীতি বিয়াম ফাউন্ডেশনে চলে আসি। মিনিট ২/৩ পরেই আমার স্ত্রী উদ্বিগ্ন কণ্ঠে আমাকে ফোন দিয়ে তার কাছে যেতে বলেন। স্ত্রী জানান, তিনি ৭টা ৩০ মিনিটের কয়েক সেকেন্ড আগে দৌড়ে এসে দেখেন হাজিরা খাতা অধ্যক্ষের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অধ্যক্ষের রুমে প্রবেশ করে দেখেন তার স্বাক্ষরের জায়গায় অধ্যক্ষ লাল কালির ক্রস ('X') চিহ্ন দিচ্ছেন।
এরপর আমি সেখানে যাই। অধ্যক্ষের রুমে প্রবেশ করতে গেলে তাঁর দ্বাররক্ষী বাধা দিয়ে বলেন অধ্যক্ষের অনুমতি ছাড়া কক্ষে প্রবেশ করা যাবে না। আমি অতিরিক্ত সচিব পরিচয় দেওয়ার পরও তিনি বলেন, স্যারের পারমিশন ছাড়া ভেতরে যাওয়া নিষেধ। আমি তার নিষেধ না মেনে ভেতরে গিয়ে দেখি উনি এবং উপাধ্যক্ষ নূরে দীবা বসে আছেন। আমার পেছনে আমার স্ত্রীও প্রবেশ করেন। আমি অধ্যক্ষকে বলি, 'আমরাও তো অফিস চালাই এভাবে তো কেউ সামনে হাজির থাকলে আমরা লাল কালি না দিয়ে স্বাক্ষর করতে দিই।’
এরপর আমার স্ত্রী ৭টা ৩১ মিনিট সময় লিখে তার স্বাক্ষর করেন। তারপর আমি তাকে বাইরে চলে যেতে বলি। আমি অধ্যক্ষকে বলি, 'আপনি খুবই ঠান্ডা মাথার মানুষ এবং আমার স্ত্রীকে সহজ-সরল দেখে পেছনে লেগেছেন, আমি কিন্তু খুব গরম মাথার নই।'
উল্লেখ্য, অধ্যক্ষ হিসেবে সাজ্জাদুর রহমান এখানে যোগদান করার পর অনেকবার আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তিনি আমার স্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের দীর্ঘদিনের প্রাপ্য পদোন্নতির সভার জন্য নথি উপস্থাপন করেছেন এবং জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে এ সকল শিক্ষক পদোন্নতি পেয়েছেন। অপরদিকে অধ্যক্ষ সাজ্জাদুর রহমান আমার কাছেও তার চাকরি স্থায়ীকরণ, ড্রাইভারের বদলি ফেরানোর মতো তদবিরও করেছেন।
আমার স্ত্রী উচিত কথা বলেন এবং অভ্যাসগতভাবে একটু উঁচু কণ্ঠে কথা বলেন। কিন্তু তিনি অত্যন্ত নীতিবান মানুষ। অধ্যক্ষ সাজ্জাদুর রহমান এর সবই জানেন। তাই আমার স্ত্রীর প্রতি এতটা বিদ্বেষের কারণ আমরা বুঝতে পারছিলাম না। কয়েক মাস আগে আমার স্ত্রী জানিয়েছেন, অধ্যক্ষ আশঙ্কা করছেন যে আমার স্ত্রী নাকি একসময় উপাধ্যক্ষ হবেন এবং তারপরে তাকে তাড়িয়ে অধ্যক্ষ হবেন। এ অবস্থায় আমাদের মনে হলো, অধ্যক্ষ অহেতুক সন্দেহ করে আমার স্ত্রীকে সূক্ষ্ম কৌশলে কর্তৃপক্ষের কাছে ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য কাগজপত্র তৈরি করছেন। তাছাড়া তিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের চাকরিতে আমার ব্যক্তিগত সুনাম এবং পরিচিতির কথাও জানেন। তাই হয়ত মিথ্যা আশঙ্কা করছেন যে আমার পরবর্তী প্রমোশন হলে আমার স্ত্রীর অবস্থান আরও ভালো হবে। যদিও এমন কোনো উচ্চাভিলাস আমার স্ত্রী ও আমার মধ্যে নেই। যদিও তিনি (অধ্যক্ষ) আটঘাট বেঁধে নেমেছেন।
জেইউ/এমজে