করোনা ঠেকাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার অভাব, দাবি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্য বিভাগের সম্মিলিত প্রচেষ্টার অভাব সুস্পষ্ট বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা না থাকায় দেশে আক্রান্তের হার বহুগুণ বেড়েছে, একইসঙ্গে বেড়েছে আইসিইউ-এর (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চাহিদা।
রোববার রাতে (৪ এপ্রিল) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘করোনাভাইরাস : জটিল ভাইরাস প্রতিহত করতে বিভ্রান্তিকর বাস্তবায়ন পদ্ধতি’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এ মতামত জানান।
তারা বলেন, জানুয়ারির শেষ এবং ফেব্রুয়ারিতে দেশে করোনার সংক্রমণ কমায় নির্বাচনী জনসভা, বিয়েশাদির মতো সামাজিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি শুরু হয়ে যায়। এতে সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে এখন রীতিমতো সুনামির ঢেউ হয়ে আসছে। বাংলাদেশে এখন সংক্রমণের হার সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, গত আট-নয় মাসে হাসপাতালের রোগী ধারণক্ষমতা, আইসিইউসহ অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম বাড়ানো হয়নি। গত বছরের তুলনায় এবার করোনার লক্ষণ দেখা যাবার পর অতি দ্রুত হাসপাতালে আসার মতো অবস্থা বেশি তৈরি হচ্ছে। এবার হাসপাতালে আসা রোগীদের জন্য আইসিইউও বেশি লাগছে। এই চেইন ভাঙতে না পারলে তা গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেবে।
প্রাথমিকভাবে ভ্যাকসিন সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দারুণ সফলে হলেও ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচিতে ভীষণভাবে ব্যর্থ। শুধু একটি ভ্যাকসিনের ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। ভ্যাকসিন নেয়ার কারণে কেউ মারা যান না। আবার এক ডোজ ভ্যাকসিন নিলেই কারো করোনা হবে না তাও সঠিক নয়। তবে ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের একটি নির্দিষ্ট সময় পর করোনাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার শূন্যই বলা চলে। তখন মানুষ আক্রান্ত হলেও সেটা গুরুতর পর্যায়ে যায় খুবই কম। এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন আর সম্পৃক্ত করতে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করলে ফল পাওয়া যাবে।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ নেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন, বিএসএমএমইউ-এর ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান এবং আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিন-এর রিসার্চ ম্যানেজার ডা. আরমান রহমান। ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার।
আলোচনার শুরুতে ডা. মুশতাক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে এরকম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে আমরা আবারও জটিল সময়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। ইতোমধ্যেই সুনামির ঢেউ উঠে গেছে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ এবং গোটা ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার সবচেয়ে কম ছিল। ওই সময় টিকাও চলে আসে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ এমনকি দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়েন। সংক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসাথে মৃত্যুর হারও বেড়েছে। তাছাড়া ব্রিটেন, ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্টও দেশে এসেছে।
ডা. আরমান বলেন, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, ওবেসিটি- সব মিলিয়ে আগে শোনা গেছে বৃদ্ধদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। কিন্তু এখন অনেক অল্পবয়সী তরুণও করোনায় মারা যাচ্ছে। বাস্তবতা হলো, কোন রোগী আইসিইউতে যাবেন, আর কে যাবেন না এটা এখনও কেউ জানেন না। তাই করোনা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা তৈরি করা।
ডা. মুশতাক ডা. আরমানের সাথে সহমত পোষণ করে বলেন, দেশের মানুষের মধ্যে লকডাউন শব্দটার প্রতি একটা ভীতি তৈরি হয়ে গেছে যেটা কাম্য নয়। যাই হোক, এই শব্দটা ব্যবহার না করে বিকল্প কিছু ব্যবহার করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যারা দিনে আনে দিনে খায় তাদের কয় দিন ঘরে আটকে রাখা যাবে? স্বল্প সময়ের জন্য পরিপূর্ণ লকডাউন করা যেতে পারে। আর ওইসময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে, যেসব স্থানে জনসমাগম বেশি হয় সেখানে যেন স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়। পুলিশ দিয়ে লকডাউন কার্যকর করায় কোনো ফল আসবে না। জনসম্পৃক্ততার কোনো বিকল্প নেই।
অধ্যাপক সায়েদুর বলেন, বাংলাদেশে এখন সংক্রমণের যে হার তা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থামাতে ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে দুই থেকে তিন সপ্তাহের জন্য কারফিউ জারি করা প্রয়োজন। শিল্পকারখানা খোলা রেখে, তাদের জন্য পরিবহণ ব্যবস্থা চালু রেখে লকডাউন করে কোনো লাভ হবে না। তাছাড়া শুধু একটি ভ্যাকসিনের উপর নির্ভর করে থাকায় বর্তমানে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তাতেও জনগণ চরম মাত্রায় হতাশ হয়ে পড়েছে।
কিন্তু ডা. মুশতাকের মত- কারফিউর মতো ব্যবস্থা করা হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য যে সামাজিক নিরাপত্তা আর সহায়তা প্রয়োজন তার জন্য সরকার বা দায়িত্বশীল অন্যান্য গোষ্ঠী প্রস্তুত নয়। চীন, ভিয়েতনামের মতো দেশ মানুষকে ঘরে রাখতে শুধু কঠোর ব্যবস্থাই নেয়নি, জনগণের জীবন-জীবিকার দায়িত্বও নিয়েছে।
ডা. আরমান অবশ্য অধ্যাপক সায়েদুরের সাথে সুর মিলিয়ে বলেন, করোনা এমন এক রোগ যেটাকে আংশিক শক্ত লকডাউন আবার আংশিক নমনীয় হয়ে নিঃশেষ করা যাবে না। করোনা সম্পর্কে বাংলাদেশে এমনকি অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও ভুল ধারণা রয়েছে। তাদের সঠিক ধারণা দেয়া সম্ভব হয়নি।
ভ্যাকসিন প্রদানের ক্ষেত্রেও ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, পুরুষ-নারী, শহর-গ্রাম এভাবে বৈষম্য হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক সায়েদুর বলেন, প্রাথমিকভাবে ভ্যাকসিন সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দারুণ সফলে হলেও ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচিতে ভীষণভাবে ব্যর্থ। একাধিক উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ, ভ্যাকসিন উৎপাদনের সামর্থ্য তৈরির দিকে নজর দেওয়া, বড় ধরনের সমন্বয় না করাতে এটা হয়েছে।
সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও ভ্যাকসিন বিরোধী গোষ্ঠী রয়েছে বলে মনে করেন ডা. আরমান। তিনি বলেন, তারা মানুষকে ভ্যাকসিন গ্রহণে নিরুৎসাহিত করেন। এছাড়া ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে অনেকে মারা যাচ্ছেন এমন গুজবও চালু আছে। বাস্তবতা হলো, ভ্যাকসিন নেয়ার কারণে কেউ মারা যান না।
অধ্যাপক সায়েদুরও বলেন, ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের একটি নির্দিষ্ট সময় পর করোনাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার শূন্যই বলা চলে। মানুষ আক্রান্ত হলেও সেটা গুরুতর পর্যায়ে যায় খুবই কম। গত আট-নয় মাসে হাসপাতালের রোগী ধারণক্ষমতা, আইসিইউসহ অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম বাড়ানো হয়নি। আমরা ধারাবাহিক একটি মহামারির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
টিআই/এইচকে