পুলিশের ভুল কৌশলই কি কাল হলো অপহৃত কিশোর নুর নবীর?

Mizanur Rahman

০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৭ এএম


পুলিশের ভুল কৌশলই কি কাল হলো অপহৃত কিশোর নুর নবীর?

সংগৃহীত

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা এলাকা থেকে নিখোঁজ কিশোর নুর নবী (১৪) হত্যা মামলার জট খুলতে শুরু করেছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত হোসেন নামে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর গ্রেপ্তারের পর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

সেখানে তিনি ঘটনার দায় স্বীকার করে কামরুল ইসলাম নামে এক নির্মাণ শ্রমিকের জড়িত থাকার কথা বলেছে। এছাড়া গ্রেপ্তারের পর অভিযুক্ত হোসেন তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন নুর নবীকে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কাহিনী।

এদিকে, নুর নবী হত্যাকাণ্ডের কারণ যতই স্পষ্ট হচ্ছে, ততই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের গাফিলতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। নুর নবী নিখোঁজের পর থেকে থানা পুলিশ তাকে উদ্ধারে যথেষ্ট তৎপরতা চালায়নি। তাদের মধ্যে এক ধরনের গা-ছাড়া ভাব ছিল। কয়েকদিন সময় পাওয়ার পরও পুলিশ অপহরণকারীদের ভুল কৌশল প্রয়োগ করেছে।

জানা গেছে, অভিযুক্তরা নুর নবীকে অপহরণের পর পরিবারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এই টাকা পরিশোধের জন্য একটি বিকাশ পার্সোনাল নম্বর প্রদান করে। এসময় অপহরণকারীরা ভুক্তভোগীর পরিবারের লোকজনকে ওই বিকাশ নম্বরে ফোন করতে নিষেধ করেছে এবং দ্রুত টাকা পাঠাতে বলে। তবে ভুক্তভোগীর পরিবার আগে টাকা না পাঠিয়ে পুলিশের কথা মতো বিকাশ নম্বরটি তাদের পাঠাতে বলে। বিকাশ পার্সোনাল নম্বর পেয়ে পুলিশ ওই নম্বরে ফোন করে টাকা পাঠানোর জন্য আরেকটি এজেন্ট নম্বর দিতে বলে। পুলিশের ধারণা ছিল এজেন্ট নম্বর হলে দোকানের অবস্থান নিশ্চিত হলে টাকা উঠানোর সময় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা যাবে। কিন্তু সহজ এই কৌশলের প্রয়োগ করতে গিয়ে কাল হলো নুর নবীর। অভিযুক্তরা মুক্তিপণ আদায়ের আশা ছেড়ে দিয়ে ভুক্তভোগীকে হত্যা করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম নগর পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখনই পুলিশ বিকাশ পার্সোনাল নম্বর পেয়েছে তখনই ওই নম্বরের অবস্থান চট্টগ্রামে শনাক্ত করতে পেরেছিল যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। এক্ষেত্রে দ্রুত তারা চট্টগ্রামের স্থানীয় থানাকে জানাতে পারত। আর স্থানীয় থানা কয়েকটি টিম নিয়ে অভিযান চালাতে পারত। কিন্তু যাত্রাবাড়ী থানা বিষয়টি চট্টগ্রামের পুলিশকে অবহিত করেনি। আর ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ পেলেও অভিযুক্তরা নুর নবীকে হত্যা করত না বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।

'এক্ষেত্রে পুলিশ ভুক্তভোগীর পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ পাঠিয়ে দিতে বলতে পারত। সেই টাকা পেয়ে কিশোর উদ্ধার হলে তদন্তের পর অভিযুক্তদের শনাক্ত করে মুক্তিপণের সেই টাকা উদ্ধার করতে পারত। কিন্তু যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ ভুক্তভোগীর পরিবারকে অল্প টাকা পাঠিয়ে এজেন্ট নম্বর নিতে বলেছে। এরই মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ অপহরণকারীদের নির্দেশনা না মেনে বিকাশ নম্বরে ফোন করে বসেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে অপহরণকারীরা বিকাশে পাঠানো ৫ হাজার টাকা আর গ্রহণ করেননি এবং মুক্তিপণ আদায়ের আশা ছেড়ে দিয়ে নুর নবীকে হত্যা করে।

তিনি আরও বলেন, যাত্রাবাড়ী থানার পাশাপাশি ভুক্তভোগীর পরিবার র‍্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। র‍্যাব তাদের নিয়মিত মামলা দায়েরের পরামর্শ দেয়। র‍্যাবের পরামর্শের পর ভুক্তভোগীর পরিবার মামলার জন্য যাত্রাবাড়ী থানায় যোগাযোগ করে। কিন্তু থানা মুক্তিপণ দাবির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরও ভুক্তভোগীর পরিবারের মামলা নেয়নি। যে কারণে র‍্যাব বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি কাজ করতে পারেনি। সবমিলিয়ে খুন হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় কিশোর নুর নবীকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কিশোর নুর নবী নিখোঁজের ঘটনায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের হওয়া সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ওসমান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিকাশ পার্সোনাল নম্বর ব্যক্তির হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অনেক সময় টাকা নিয়ে উত্তোলন করেন না। আর এজেন্ট নম্বর হলে দোকানিকে শনাক্ত করা যায়। ওই দোকানে টাকা উত্তোলন করার সময় সহজেই অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা যায়।  আমরা এই কৌশলের প্রয়োগ করেছি। এজন্য অভিযুক্তদের দেওয়া বিকাশ নম্বরে আমি ফোন করেছি। তবে আমি পুলিশের পরিচয় দিইনি। শুধুমাত্র পার্সোনাল নম্বরে টাকা যাচ্ছে না বলে এজেন্ট নম্বরে দিতে বলেছি। যদিও পার্সোনাল নম্বরের অবস্থান আমরা চট্টগ্রামে শনাক্ত করতে পেরেছিলাম। এজেন্ট নম্বর দিলে সহজে ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা যেত, এই চিন্তা ও কৌশল থেকে ফোন দিয়েছি। আপনি নেগেটিভভাবে উপস্থাপন করিয়েন না।’

ভুক্তভোগী নুর নবীর বাবা গোলাম রসুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, অপহরণকারীরা কিন্তু আমাদের বার বার বিকাশ নম্বরে ফোন দিতে মানা করেছিল। তাই আমরা ফোন দিইনি। পুলিশ কেন ফোন দিয়েছে আমি জানি না। আমরা নিরীহ মানুষ। শুরু থেকে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছি। তারা যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে সেভাবে কাজ করেছি। পুলিশ আমাদের বলেছে আপনারা একটি বিকাশ নম্বর দিলে সঙ্গে সঙ্গে জানানোর জন্য। আমরাও বিকাশ নম্বর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে টাকা পাঠানোর আগেই এসআই ওসমানকে জানিয়েছি। এসআই ওসমান আমাদের বলেছেন, যত টাকা পারা যায় তত টাকা পাঠানোর জন্য। আমরা ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। এরপর আমার ইমো নম্বর যেটাতে আগে থেকে অপহরণকারীরা যোগাযোগ করে আসছিল সেখানে মেসেজে তারা জানায় আমরা কেন বিকাশ নম্বরে ফোন করেছি। এ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা ইমোতে ব্লক করে দেয়। এরপর আমরা আর অপহরণকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। এ ঘটনার পরদিন আমার ছেলের মরদেহ পাওয়া যায়।

তিনি আরও বলেন, ছেলেকে উদ্ধার করতে যখন র‍্যাবের দ্বারস্থ হই তখন আমাদের তারা বলেন একটি মামলা দায়ের করতে। কারণ মামলা ছাড়া নাকি র‍্যাব কাজ করতে পারেন না। এরপর আমরা মামলার জন্য যাত্রাবাড়ী থানার ওসিকে অনুরোধ করেছি। তিনি আমাদের বলেছেন 'মামলা করা লাগবে না। ভুক্তভোগীকে উদ্ধারে আমরা কাজ করছি। আল্লাহ আল্লাহ করেন।

এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মো. মফিজুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলেটি উদ্ধারে আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছেলেটির মরদেহ চট্টগ্রামে পাওয়া।

জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার হিলভিউ আবাসিক এলাকার ১০ নম্বর সড়কের পাশে একটি গ্যারেজের সামনে থেকে কিশোর নুর নবীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। পরে সেখানে নুর নবীর বড় ভাই রমজান হোসেন গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করেন। এ ঘটনায় নুর নবীর বড় ভাই রমজান হোসেন বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

পাঁচলাইশ থানার তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মামলার তদন্তের শুরুতে বিকাশের দোকানিকে গ্রেপ্তার করে সন্দেহজনক আসামি হিসেবে আদালতে প্রেরণ করা হয়। তবে তার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তার জামিনও হয়ে গেছে। যে হোসেন নামে এক প্রতিবেশী জন্মদিন পালনের কথা বলে নূর নবীকে বাড়ি থেকে ডেকে আনে। ঘটনার পর হোসেন ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাকে জামালপুরের সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।  হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ২৯ আগস্ট অভিযুক্ত কিশোরকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. অলি উল্লাহর আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে অভিযুক্ত কিশোর হোসেন জানান, তার পরিবারে মা এবং বোন রয়েছেন। তার বাবা আগে মারা গিয়েছেন। মাসখানেক আগে হোসেন মায়ের জমানো ২০ হাজার টাকা চুরি করে বন্ধুদের নিয়ে খরচ করে ফেলে। এরপর মা চাইলে এই টাকা কীভাবে ফেরত দেবে সে চিন্তায় বিভোর হয়ে ওঠে। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেশী নির্মাণ শ্রমিক কামরুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করে।

কামরুল অভিযুক্ত হোসেনকে পরামর্শ দেয়- নুর নবীকে জন্মদিনও পালনের কথা বলে অপহরণ করতে। কামরুলের পরামর্শে রাজি হয়ে ২১ আগস্ট জন্মদিন পালনের কথা বলে নুর নবীকে ঢাকা থেকে প্রথমে ফেনীতে নিয়ে আসে হোসেন। কামরুলের গ্রামের বাড়ি ফেনীতে। এরপর ফেনী থেকে কামরুলসহ চট্টগ্রামে যায় দুই বন্ধু।

তাদের পরিকল্পনা ছিল নুর নবীর পরিবার থেকে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করবে। সেখান থেকে হোসেন তার মা থেকে চুরি করা ২০ হাজার টাকা ফেরত দেবে। বাকি টাকা কামরুল এবং হোসেন দুজনের ভাগ করে নেবে। কিন্তু চাহিদামতো মুক্তিপণ না পেয়ে এবং ভুক্তভোগীর পরিবার বিকাশ নম্বরে যোগাযোগসহ বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা চালানোয় ধরা পড়ার ভয়ে নুর নবীকে তারা হত্যা করে।

পাঁচলাইশ থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নুর নবী হত্যা মামলা অভিযুক্ত এক কিশোর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এরপর আদালত তাকে গাজীপুরে শিশু ও কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। জবানবন্দিতে অভিযুক্ত কিশোর এক নির্মাণ শ্রমিকের পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জানায়। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আশা করি, শিগগিরই অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনা হবে।

এমআর/এসকেডি

Link copied