‘ডিসির বক্তব্য বিরোধী দলের অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণ করে’

‘আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে’ -এমন বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন জামালপুরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) পদ থেকে সদ্য বদলি হওয়া ইমরান আহমেদ। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন জেলা প্রশাসকের এ ধরনরে বক্তব্য সরকারি কর্মচারী বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ডিসির এ ধরনের বক্তব্যের মানে হলো সরকারকে বিব্রত করা, বিরোধীদের অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণ করা।
গত ১১ সেপ্টেম্বর জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌরসভার নতুন ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ইমরান আহমেদ বলেন, ‘আমাদের একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, আমাদের স্বাধীনতা অনেক কষ্ট করে অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতার সুফল আজকের যোগাযোগ উন্নয়ন, যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এই সরকার যে উন্নয়ন করেছে সেটির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এই সরকারকে আবার নির্বাচিত করে ক্ষমতায় আনতে হবে। এটা হবে আমাদের প্রত্যেকের অঙ্গীকার। আমি এটা মনে করি, আপনারা নিজের চোখে দেখে সরকারের প্রতি অকৃতজ্ঞ হবেন না। আমি এটি বিশ্বাস করি। উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে, উন্নয়ন হতে থাকবে। এক সময় আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হব।’
ডিসির এমন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা হয়ে দলের পক্ষে ভোট চাওয়া বা ক্ষমতায় আনতে চাওয়া আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি।
আরও পড়ুন : জামালপুরের সেই ডিসিকে সরিয়ে দিল সরকার
জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনে মহানগরগুলো বাদে জেলাগুলোতে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব ডিসিরাই পালন করেন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা ও আচরণবিধি অনুযায়ী কাজ করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
নির্বাচনে প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনকেও নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। বিশেষ করে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এজন্য এ পদে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের অনুগত কর্মকর্তাদের দিয়ে নির্বাচনী মাঠ সাজান বলে বিরোধী দল থেকে প্রায় অভিযোগ করা হয়।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন ডিসির এ ধরনের বক্তব্যের মানে হল বিরোধী দলের এ অভিযোগকে সত্য বলে প্রমাণ করা।
কোনো দলের পক্ষে ভোট চাওয়া আচরণ বিধির পরিপন্থি কাজ
একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে কোনো দলের পক্ষে ভোট চাওয়া আচরণ বিধির পরিপন্থি কাজ বলে মনে করেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান।
আরও পড়ুন : জামালপুরের ডিসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলল ইসি
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একজন গণকর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের সভায় যেতে পারেন না বা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বসে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করতে পারেন না। কোনো গণকর্মচারী কোনো দলের পক্ষে বা মার্কার পক্ষে ভোট চাইলে এটা আচরণবিধির পরিপন্থি কাজ। এ পরিপন্থি কাজ করলে নিয়মেই আছে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত হবে, ব্যবস্থা হবে। এ ধরনের বক্তব্য রাখলে তাহলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন গণকর্মচারী রাষ্ট্রের কর্মচারী। তিনি রাজনৈতিক দলের পক্ষে কোনো ধরনের বক্তব্য, বিবৃতি বা সমর্থন ব্যক্ত করতে পারেন না। এটা বেআইনি। ডিসির জন্য আরও সংবেদনশীল। ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসিসহ যারা নির্বাচনের কাজে যুক্ত হবেন তাদের এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া মানে হলো সরকারকে বিব্রত করা এবং বিরোধী দলের অভিযোগকে সত্যি বলে প্রমাণ করা।’
কী আছে আচরণ বিধিমালায়?
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫(১) ধারায় (রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ) বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।’
আরও পড়ুন : জামালপুরের মতো ডিসিদের দিয়ে ‘ক্রেডিবল’ নির্বাচন হবে না
২৫(৩) ধারায় বলা হয়, ‘সরকারি কর্মচারী বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অথবা অন্য কোন আইন সভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অথবা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে বা অন্য কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করতে বা প্রভাব খাটাতে পারবেন না।’
বিধিমালা লঙ্ঘনের শাস্তির বিষয়ে এতে বলা হয়, ‘এই বিধিমালার যে কোন বিধান লঙ্ঘন সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫ এর আওতায় অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে এবং কোনো সরকারি কর্মচারী এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি বিধিমালার আওতায় অসদাচরণের দায়ে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দায়ী হবেন।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি আচরণ বিধির পরিপন্থি কাজ করেছেন। এজন্য বিধি অনুসারে তার শাস্তি পাওয়ার কথা।
ডিসির বক্তব্য খতিয়ে দেখার পর ব্যবস্থা
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, নির্বাচন নিয়ে ডিসি ভিডিওতে যা বলেছেন তা খতিয়ে দেখা হবে। একজন ডিসি এমন কথা বলতে পারেন না। তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন : জামালপুরের ডিসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লিগ্যাল নোটিশ
তবে কেউ বক্তব্য বিকৃত করে প্রচার করেছে কী না তাও যাচাই করা হবে -এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, এখন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগ, বক্তব্য টুইস্ট করা যায়। ডিসির বক্তব্য খতিয়ে দেখার পর সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো ইমরান আহমেদকে
সমালোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে ইমরান আহমেদকে ডিসির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদে বদলি করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
পৃথক প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন অ্যাকাডেমির উপ-পরিচালক (উপসচিব) শফিউর রহমানকে জামালপুরের ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এসএইচআর/এসএম
