সোনাসহ আটক চিকিৎসককে ছেড়ে দেওয়া হলো কার নির্দেশে?
চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চোরাচালান করে আনা চারটি সোনার বারসহ আটক হওয়া এক চিকিৎসককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় কোনো মামলাও দায়ের করেনি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে অভিযুক্ত চিকিৎসক যে ব্যক্তির সোনা পরিবহন করেছিলেন তাকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এটি সম্পূর্ণরূপে বেআইনি হয়েছে বলে মনে করছেন ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে অভিযুক্ত চিকিৎসককে তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে আইনজীবীরা বলছেন, সোনার বারগুলোর মালিক একজন সাধারণ যাত্রী। এখানে একজন চিকিৎসক সেগুলো পরিবহন করেছেন। বিষয়টি তিনি নিজে স্বীকারও করেছেন। এর মানে তিনি সরাসরি চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা দায়েরই একমাত্র ব্যবস্থা।
আরও পড়ুন
জানা গেছে, সোমবার (২৯ জানুয়ারি) সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ডা. এম জেড এ শরীফকে চারটি সোনার বারসহ আটক করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। অভিযুক্ত শরীফ ২৭তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা। তিনি বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
ওই সময় অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও এ প্রতিবেদকের হাতে সংরক্ষিত রয়েছে। সেখানে অভিযানে থাকা কর্মকর্তারা এম জেড এ শরীফকে কোন পদে আছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি নিজেকে হেলথ অফিসার হিসেবে পরিচয় দেন।
কাস্টমস সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ডা. শরীফ স্বীকার করেন, সকালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে চট্টগ্রামে পৌঁছান। ওই ফ্লাইটে দেশে ফেরেন চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ হালিশহর নাবিক কলোনির বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন। তিনি ৪৬৪ গ্রাম ওজনের চারটি স্বর্ণের বার আনেন।
বিমানবন্দরে পৌঁছে অভিযুক্ত আলাউদ্দিন ডা. শরীফের কাছে সোনার বারগুলো হস্তান্তর করেন। শরীরে লুকিয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসক সোনার বারগুলো বিমানবন্দর পার করে দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তার শরীর তল্লাশি করে কাস্টমস কর্মকর্তারা সোনার বারগুলো জব্দ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সোনা চোরাচালানের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যে মো. আলাউদ্দিনকে আটক করা হয়। যদিও কোনো মামলা না করে দুজনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
মামলা না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি বিষয়টি টিভিতে দেখেছি। এখন পর্যন্ত আমার কাছে কেউ আসেনি, মামলাও হয়নি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আবদুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে একজন ব্যক্তির সোনা একজন চিকিৎসক পরিবহন করেছেন। ওই চিকিৎসকের কাছ থেকে সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। তার মানে তিনি চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করতে হবে। একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। মামলা না নিয়ে ছেড়ে দেওয়ায় আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মহিউদ্দিন পাটোয়ারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযুক্ত চিকিৎসককে স্বাস্থ্য বিভাগের তিনজন কর্মকর্তার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন- স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. সুমন বড়ুয়া, ডা. ইফতেখার উদ্দিন ও বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জাবেদ। আর জব্দকৃত সোনার বারগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত দেখানো হয়েছে। জিম্মায় নেওয়ার সময় অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
একটা ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হয়েছে? জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার বলেন, ‘সবকিছু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হয়েছে।’
ডা. শরীফ ২০১২ সাল থেকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তার বাড়ি বিমানবন্দরের পাশে পতেঙ্গা থানা এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দরে কর্মরত থাকার সুবাদে অসাধু চক্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে উঠতে পারে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, চিকিৎসকদের সংগঠনের নেতাদের তদবিরের মুখে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, ঘটনার পরপর বিমানবন্দর থেকে ডা. শরীফকে প্রত্যাহার করেছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তর। পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, এ ঘটনার পরই ওই কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে ব্যক্তির দায় স্বাস্থ্য বিভাগ নিবে না।
এমআর/এমজে