রোগী-মরদেহ নিয়েই তাদের ছুটে চলা

>> দেশে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য আলাদা কোনো সুবিধা নেই
>> অসহায় রোগী ও লাশ গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চাঁদা তোলেন চালকরা
>> টোল দিয়েই ব্রিজ পার হতে হয় অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে
দিন গড়িয়ে রাত হয়, আবার রাতের শেষে দেখা মেলে নতুন দিনের, কিন্তু তাদের প্রতিনিয়তই ছুটে চলতে হয় লাশ অথবা রোগী নিয়েই। করোনাভাইরাসের এ সময়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ‘প্রথম সারির যোদ্ধা’ হিসেবে কাজ করছেন তারা। ডাক এলেই আর ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই তাদের। রোগী কিংবা প্রাণহীন মানুষদের নিয়ে গন্তব্যে ছুটতে হয় প্রতিদিন।
বলছিলাম, অ্যাম্বুলেন্স চালকদের কথা। যারা স্বাস্থ্যকর্মীদের মতো করে চিকিৎসাসেবা না দিলেও অসুস্থ মানুষরা সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখে চলেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে এসব চালকদের ত্যাগ করতে হয় অনেক কিছু।
জীবন ও জীবিকা নিয়ে কথা হয় ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের সামনে যাত্রী হিসেবে রোগী অথবা লাশের অপেক্ষায় থাকা অ্যাম্বুলেন্স চালক ইলিয়াস মিয়া, উজ্জ্বল মিয়া, নাসির আহমেদ, সোহাগ, পাপ্পু এবং মুন্নাসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তারা বলেন, ‘আমাদের লাইনটা লাশ না হয় রোগীদের নিয়ে। সুখ, দুঃখ বলতে আমাদের জীবনে কিছু নেই’।
১৮ বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্স চালাচ্ছেন মো. রিপন পাটোয়ারি, নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিক্যালে ১৮ বছর ধরে আসা যাওয়া করছি। হাজার হাজার রোগী, লাশ বহন করেছি। দেখা গেছে, মাঝে-মধ্যে এমন অসহায় রোগী অথবা লাশের স্বজন পাওয়া যায়, যাদের বাড়ি ফেরার টাকা নেই। যখন তাদের স্বজনরা এসে বাড়ি যাওয়ার টাকা নেই বলেন, তখন একজনকে দিলে চাপ হয়ে যায়। আমরা চালকরা সবাই মিলে চাঁদা তুলে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করি। অথচ আমাদের দেখার কেউ নেই।’
আমাদের দেশে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য আলাদা কোনো সুবিধা নেই, রাস্তা নেই। রাজধানী ঢাকাতে যে যানজট অ্যাম্বুলেন্স চালানোর কোনো সুযোগ নেই। এ পেশায় এসে মনে হলো সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছি। যেহেতু এ পেশা বেছে নিয়েছি অনেক কিছুই সহ্য করতে হবে। শুনেছিলাম, সব জায়গায় টোল ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স চালানো যাবে অথচ আজও সেটা কার্যকর হয়নি। আমাদের টোল ফি দিয়ে প্রতিটি ব্রিজ পার হতে হচ্ছে এখনও।
অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. রিপন পাটোয়ারি
অ্যাম্বুলেন্স চালক রিপন বলেন, ‘যদিও নিয়ম করে দিনে সাত ঘণ্টা ঘুমানোর প্রয়োজন, আমাদের ঘুম হয় সর্বোচ্চ ৪ ঘণ্টা। বাকি সময়টা পথেই থাকতে হয়। তবে অতিরিক্ত পরিশ্রম মনে হলে সময় নিয়ে বিশ্রাম নিই।’
এ পেশায় পরিবারের সমর্থন রয়েছে কি না- জানতে চাইলে এ চালক বলেন, ‘একবার আমি কুমিল্লায় রোগী নিয়ে গিয়েছিলাম, আসার পথে এলিটগঞ্জে আমার সামনে বাইক দুর্ঘটনা হয়। আমি গাড়ি নিয়ে লোকটির সামনে দাঁড়ানো। অথচ লোকটিকে গাড়িতে ওঠাতে পারছি না। অভিভাবক ছাড়া গাড়িতে তুললে মামলা খেতে হবে। এমন সময় আমার স্ত্রী আমাকে ফোন দেয়, তাকে বিষয়টা খুলে বললে সে আমাকে উৎসাহ দেয় লোকটাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। নিজের পকেটের এক হাজার ৬০০ টাকা খরচ হয় আমার। সেখানে অনেক সাধারণ মানুষ দাঁড়ানো ছিল। কিন্তু লোকটিকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেননি।’
গতকাল থেকে এখনও কোনো ট্রিপ পাইনি, অপেক্ষা করছি যদি একটি মেলে। করোনার জন্য অবস্থা খুব একটা ভালো না। পরিস্থিতি খুব খারাপ। এখন আগের চেয়ে অনেক কম ভাড়া দিয়ে রোগী বহন করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় তো কারও থেকে ভাড়া বেশি চাওয়াও যায় না। এখন কিছুটা সুবিধা হলেই নিয়ে নেই। ভাড়া নিয়ে এখন দর কষাকষি করার সময় না।
অ্যাম্বুলেন্স চালক রুবেল মিয়া বলেন
তিনি আরও বলেন, ‘জীবন আসলে অনেক কঠিন। দেখা গেছে, লাশ নিয়ে দীর্ঘ পথে যাত্রা করেছি, মাঝপথে খিদা লাগলেও কিছু খেতে পারি না। আমি লাশ রেখে খাব, না গাড়ি চালাব। মানবিক বিবেচনায় অধিকাংশ সময় না খেয়েই রওনা দেই।’
কথার ফাঁকে আরেক চালক নাসির আহমেদ বলেন, ‘যখন রোগী না থাকে ঢাকা মেডিক্যালে আমাদের সময় যায় গল্প ও আড্ডা দিয়ে। আমরা সবাই মিলেমিশেই আছি। একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করছি। এসবে নিজেরাও একটু আনন্দ পাই।’
এ প্রসঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স মালিকদের সংস্থা ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মো. বাবুল দেওয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘করোনা রোগী ঢাকা মেডিক্যালে বেশি থাকার কারণে নতুন রোগী নিয়ে এলে অনেক সময় রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে এ বিষয়টা নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে চালকদের।’
আমরা যারা মহাজন রয়েছি, ব্যাংক লোন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি? দিনশেষে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের ব্যাংক ঋণের জন্য সরকারের কিছু করণীয় আছে কি না- আমাদের জন্য কিছু করতে পারলে উপকার হবে। প্রতিটি গাড়ির মাসে কিস্তি ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়। এদিকে, মেডিসিন বিভাগ বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগ চালু করলে আমাদের আমাদের চালক পেট বাঁচবে।
অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. বাবুল দেওয়ান

উল্লেখ্য, গত ২১ এপ্রিল ঢামেকের পক্ষ থেকে জারিকরা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট এবং হাসপাতালের মূল জেনারেল মেডিসিন বিভাগের ২ নম্বর ভবনকে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সে কারণে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগীদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সরিয়ে নেওয়া হবে।
এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মূলত ঢামেকে মেডিসিন বিভাগে রোগী ভর্তি বন্ধ হয়ে যায়।
এ বিষয়ে গত ২৭ ডিসেম্বর হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ‘সারা বিশ্বের পাশাপাশি আমরাও যেহেতু করানোভাইরাসের ভয়াবহতা পার করছি। এর জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আপনারা জানেন, করোনার আগে হাসপাতালের ১০ তলা নতুন ভবন মেডিসিন বিভাগ ছিল। সেখানে এখন করোনা রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে। পাশাপাশি সাসপেক্ট (সন্দেহজনক) করোনা রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে। এছাড়া, সার্জারি রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের আলাদা ইউনিটে ভর্তি করা হচ্ছে। সেখানে তাদের সার্জারি করা হচ্ছে। হাসপাতালের নতুন ভবন যেহেতু করোনা ইউনিট তাই মেডিসিন ওয়ার্ড বন্ধ থাকলেও হাসপাতালের বহির্বিভাগে কয়েকজন মেডিসিন রোগীর ভর্তি নেওয়া হচ্ছে।’
কবির হোসেন/এফআর