‘হারিয়ে যাওয়া’ বৈশাখ খোঁজেন ডুগডুগি বিক্রেতা শাহজাহান

রাজধানীর পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারে ডুগডুগি বাজিয়ে অলিগলিতে ঘুরছিলেন মো. শাহজাহান মিয়া। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে গোটা বিশেক ডুগডুগি বানিয়ে বিক্রি করতে এলেও এক ঘণ্টা যাবৎ ঘুরে একটিও বিক্রি করতে পারেননি তিনি। অথচ নিপুণ হাতে তৈরি ডুগডুগিটির দাম মাত্র ১০ টাকা। তাই অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই তিনি বললেন, ‘পহেলা বৈশাখ এখন আর নাই, কই যেন হারায়া গেছে।’
রোববার (১৪ এপ্রিল) বৈশাখের প্রথম দিনে পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় শাহজাহান মিয়ার। এসময় তিনি অতীতের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি জানান আক্ষেপের কথাও।
শাহজাহান মিয়া জানান, দীর্ঘ মাস ৫০ বছর যাবৎ হাট-বাজার আর মেলায় মেলায় ঘুরে ডুগডুগি বিক্রি করেন তিনি। একটা সময়ে জমজমাট মেলায় তার ডুগডুগির চাহিদা থাকলেও বর্তমানে তা বিক্রি করে পেট চালানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, ২০টার মতো নিয়ে বের হইছিলাম। এর মধ্যে মাত্র ৫টা বিক্রি করেছি। নিয়ে ঘুরতে ঘুরতেও কেউ দাম জিগায় না। আমিই ১০ টাকা, ১০ টাকা বলে ঘুরে বেড়াই আর বাজাই। কিছু মানুষ বাজানো দেখে হাতে নিয়ে নিজেরাও বাজায় কিন্তু কিনে না।
এই ডুগডুগি বিক্রেতা বলেন, বৈশাখের উৎসব-আয়োজন এখনো কিছু থাকলেও মানুষের মন-মানসিকতা পাল্টে গেছে। সবাই এখন মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। বাচ্চাদের হাতে বাপ-মারা এখন খেলনা না দিয়ে মোবাইল তুলে দেয়। যে কারণে নতুন প্রজন্ম এখন এগুলো চিনেও না। অথচ এই খেলনাপাতিগুলো তো আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। আমরা দুনিয়া থেকে চলে গেলে এই খেলনাগুলোও নিশ্চিত হারিয়ে যাবে। শুধু এগুলোই না, আরও অনেক প্রাচীন খেলনা আছে, সেগুলোও সংরক্ষণ করা উচিত।
আরও পড়ুন
শাহজাহান মিয়া বলেন, আমি এগুলো বিক্রি করেই টিকে আছি। আমার কাছে খুব আনন্দের ব্যবসা এটা। শুধু নতুন প্রজন্মের কাছেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা চাইলে আমাদের এই কুটির শিল্পগুলো তুলে ধরতে পারি। আমাদের দেশে বিভিন্ন দেশের খেলনা আমদানি হয়ে আসে, এদিকে আমাদের দেশের খেলনাগুলো ধ্বংসের পথে। এগুলো রক্ষা করে আমরা চাইলে বিভিন্ন দেশে সাপ্লাই দিতে পারি।

শুধু শাহজাহান মিয়ার ডুগডুগিই নয়, মাটির তৈরি নানা খেলনা-পুতুল, নাগরদোলায় চড়া, সার্কাস দেখা, মিষ্টি খাওয়া, বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটানো, সার্কাস দেখাসহ অতীতের নানা স্মৃতি আয়োজনই এখন অনেকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। বৈশাখী নানা আয়োজনের জায়গা দখল করেছে রেস্টুরেন্ট, সেলফি, বিদেশি খাবার আর চেক-ইন ভিত্তিক ফেসবুক স্ট্যাটাস। স্মার্টফোন নির্ভরশীলতায় শিশুদের জীবনও যেন হয়ে উঠেছে যন্ত্রময় এক জীবন্ত ট্রেন।
জানা গেছে, মূলত গ্রাম-বাংলার উৎসব হলেও ষাটের দশক থেকেই নগর বা শহরে বৈশাখ উদযাপনের সূচনা হয়। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় জাগরণ গড়ে তোলে ‘ছায়ানট’। এই সংগঠনের উদ্যোগেই ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে হয় প্রথম বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। সংশ্লিষ্টদের মতে, শহর কিংবা গ্রাম যেকোনো পটভূমিতেই বৈশাখ উদযাপনে ভিন্ন মাত্রিক আঙ্গিকতা পরিলক্ষিত হলেও প্রাণের উন্মাদনা যেন সবার জন্য এক। দিন বদলের সাথে সাথে আধুনিকতার ধরে অনেক পরিবর্তন এসেছে বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ উদযাপনে। তবে শহুরে সভ্যতার বর্ণিল ছোঁয়া যেন গ্রাস করে নিতে না পারে গ্রামীণ আটপৌরে জীবনের বৈশাখী আয়োজনকে, এই প্রত্যাশাই সবার।
টিআই/এসএসএইচ