শিশুদের জন্য বাবা-মাকেই সত্যিকারের রোল মডেল হতে হবে

শিশুদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে বাবা-মাকে সত্যিকারের রোল মডেল হতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, দেশীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী বাবা-মাকে শিশুদের ইমোশন বুঝে প্যারেন্টিং করতে হবে। শিশুকে ফ্যামিলি ভ্যালুজ শিক্ষা দিতে হবে। শিশুকে কোয়ালিটি টাইম দিতে হবে। তার সঙ্গে গেম খেলা, মুভি দেখাসহ তার মতো করে বাবা-মাকেও চলতে হবে।
শনিবার (১ মে) দিবাগত রাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘সন্তানের মানসিক বিকাশে বর্তমানের প্যারেন্টিং প্রাকটিস কতটা সহায়ক’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা এ মত দেন।
বক্তারা বলেন, শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট দেওয়া সম্ভব। পর্নোগ্রাফি রোধে প্রয়োজনে কিছু সফটওয়্যার রয়েছে, তাও ব্যবহার করা যেতে পারে। শিশুকে ভালো ইন্টারনেট, ভালো প্রযুক্তি দিতে হবে- এটা না হলে শিশুরা পিছিয়ে পড়বে। জেনারেশন পরিবর্তনের সঙ্গে কালচার অনুযায়ী বাবা-মাকে পরিবর্তন হতে হবে। তার (শিশু) সামনে কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না, যেখানে যে নিয়ম-কানুন রয়েছে, তা মানতে হবে। শিশুকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে প্রতিটি বাবা-মাকে সত্যিকারের রোল মডেল হতে হবে।
অনুষ্ঠানে ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দারের পরিচালনায় অংশ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন নাহার, ব্র্যাকের সাবেক পরিচালক শিপা হাফিজা এবং শিশু অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইক্রিয়াট্রিস্ট ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
ডা. ঝুনু বলেন, আগে ছিল যৌথ পরিবার, এখন দম্পতি পরিবার। তার সঙ্গে কর্মজীবী বাবা-মা। এটা এখনকার পরিবারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। বাচ্চাদের পড়ার চাপ। এই যে প্রতিযোগিতা এটা বাবা-মা চাপিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, ক্লাসে প্রথম হতে হবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। কিন্তু বলে না তোমাকে একজন ভালো মানুষ হতে হবে। এটা কিন্তু বিদেশে দেখি না, শুধুমাত্র বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে। সিঙ্গেল বাবা অথবা মায়েদেরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাছাড়া করোনাকালে বাবা-মা দুজনে যদি বাসায় থেকে অফিস করেন, তারা কিন্তু ঠিক মতো সময় দিতে পারছেন না।
তিনি আরও বলেন, এখন ওয়ানে ক্লাস হচ্ছে। ক্লাস করতে করতে দেখা যাচ্ছে শিশুরা ইউটিউব অথবা ফেসবুকে চ্যাটিং করছে- এ কথা অনেক বাবা-মায়ের কাছ থেকে প্রায়ই শুনতে পাই। তারা বলছেন, স্মার্টফোন দেওয়ার ফলে শিশুরা প্রযুক্তির ওপর আসক্ত হয়ে পড়ছে। করোনাকালে গত দেড় বছর স্কুলে না যাওয়ার কারণে ঘরের মধ্যে থাকতে থাকতে শিশুরা খিটখিটে মেজাজের হয়ে পড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই পড়াশোনাসহ সব কিছুতেই শিশুদের ছন্দপতন ঘটেছে। শিশুদের মতো বাবা-মায়ের মেজাজও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় বাবা-মা শিশুদের না বুঝে কখনও কখনও নির্যাতন করে বসছেন। আর পারিবারিক অশান্তি বেড়েই চলেছে।

বিএসএমএমইউয়ের এই অধ্যাপক বলেন, দেখা গেছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বাবা-মায়ের মধ্যে ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এটা কিন্তু সন্তানের সঙ্গে নয়। সন্তান যেখানেই থাকবে বাবা-মা উভয়কেই দায়িত্ব নিতে হবে।
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, শিশুদের ব্যক্তিত্বের বিকাশে বাবা-মায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীদের পার্থক্য হচ্ছে অন্যান্য প্রাণীরা সম্পর্ক তৈরি, আত্মীয়তা করা বা বন্ডিং তৈরি করার জায়গায় থাকে না, এটা মানুষের মধ্যে আছে। প্রাগৈতিহাসিককাল সিম্পল প্যারেন্টিং ছিল। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কারণে ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে। এ বিষয়গুলো সন্তানের ব্যক্তিত্বের ওপর প্রভাব ফেলে, তার বিকাশের ওপর প্রভাব ফেলে। শৈশবে যদি কোনো শিশুর প্যারেন্টিং বিঘ্নিত হয়, প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় নিজেও গুড প্যারেন্টিং করতে পারবে না।
তিনি বলেন, আমরা এখন গুড, ব্যাড, পজিটিভ প্যারেন্টিং বলি না। আমরা এখন বলি রেস্পন্সিভ প্যারেন্টিং। শিশুর ইমোশন বুঝতে হবে, তার না বলা কথাগুলো বুঝতে হবে। এই শিশুরা কিন্তু আমাদের আগামী দিনের অর্থাৎ আমরা যে নিউ নরমাল লাইফ বলছি, তার কাণ্ডারি হবে। যখন করোনা ছিল না, তখন ভাবতাম আমরা নরমাল আছি। কিন্তু আমরা নরমাল না। আমরা তো এখন চরম অ্যাবনরমাল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। নিউ নরমাল পৃথিবীতে আমাদের বয়সী মানুষদের খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হবে। কিন্তু এখনকার শিশুরা সেই পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেবে। এখন শিশুদের পর্যবেক্ষণ করা, তাদের অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে প্যারেন্টিং পরিবর্তন হতে হবে। শিশুরা তাদের আচরণ পরিবর্তন করবে না, শিশুদের মতো করে প্যারেন্টিংটা হতে হবে।
শিশু অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইক্রিয়াট্রিস্ট ডা. হেলাল বলেন, এটাই কিন্তু প্রথম প্রজন্ম যে বাবা-মায়েরা সন্তানের হাতে ডিভাইস দিয়েছে। এই সন্তানরাও ডিভাইস পাওয়া প্রথম প্রজন্ম। প্রথম প্রথম আমাকে এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বেগ পেতে হবে। কিন্তু তারপরও বলব, এই ডিভাইসকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের কাছে শুনতে চায় ডিভাইস মানেই খারাপ। কিন্তু আমি বলি, প্রত্যেক শিশুকে ভালো ডিভাইস, দ্রুত গতির ইন্টারনেট দিতে হবে। তা না হলে অন্যান্য দেশ এগিয়ে যাবে, আমাদের শিশুরা, আমার দেশ পিছিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, অনেকে বলেন তাহলে তো শিশুরা আসক্ত হয়ে যাবে। তাদের আমি বলি, যখন বিদ্যুৎ আবিষ্কার হয়েছিল তখন তো বলা হয়েছিল ধরলেই বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যাব। তাই বলে বিদ্যুৎ ফেলে ঘরে কুপি জ্বালিয়ে রাখব? রাখি না। এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ চাই। বিদ্যুতের তারে একটি আবরণ দিয়ে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, অন অফ করার জন্য সুইচ আছে, নিয়ন্ত্রণের জন্য রেগুলেটর আছে। বিদ্যুতের মতো করে ইন্টারনেটকে ব্যবহার করতে হবে। অনেক বাবা-মাকে বলতে শুনি আমি যেটা পারি না আমার চৌদ্দ বছরের ছেলে বা মেয়ে পারে। এই আত্মতৃপ্তি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আপনার সন্তান যেটা পারে তার চেয়ে আপনাকে বেশি পারতে হবে। প্রয়োজনে আপনাকে কোচিং করতে হবে। আপনি দক্ষ হন, সন্তানের সঙ্গে গেম খেলেন, তার প্যারালাল হন। সে যখন আপনার সঙ্গ পেতে চায়, তাকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। প্রায় শিশুই আমাদের বলেন, বাবা-মা আমাকে ঝোঝে না। এই বুঝার দায়িত্বটা বাবা-মাসহ সবার নিতে হবে। এটা রাষ্ট্রকেও বুঝতে হবে।
শিপা হাফিজা বলেন, বাবা-মা একা প্যারেন্টিং করতে পারবে না। শিশুর স্কুল আছে, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব ও সমাজ রয়েছে। অন্যান্য প্রযুক্তি তো আছেই। শিক্ষকদের কথা তো শিশুরা খুবই মান্য করে। সেক্ষেত্রে করোনা পরিস্থিতিতে শিশুরা ভ্যালুসটা শিখুক, বাবা-মায়ের সম্পর্ক কী হওয়া উচিত, বাসার কাজে শিশুরা কীভাবে বাবা-মাকে সহযোগিতা করতে পারে- এটা স্কুলের কারিকুলামের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। অনেক উন্নত দেশে এটা রয়েছে। এখান থেকে দেখা যাবে শিশুদের আচরণে উন্নতি হচ্ছে কি না।
তিনি বলেন, করোনাকালীন সময়ে যে নতুন আচরণের মধ্যে আছি, সেখানে জাতীয়ভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিচার ব্যবস্থায় সেই পরিবর্তনগুলো দেখতে চাই। এটা করা সম্ভব। যদি একটি পলিটিক্যাল সদিচ্ছা থাকে।
টিআই/এসএসএইচ