জলবায়ু পরিবর্তনে 'চরম' ঝুঁকিতে দেশ, ভূমিকা রাখতে পারে যুবারা
আবহাওয়া, জলবায়ু ও পানিজনিত ঝুঁকির কারণে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে এশিয়া। বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যেখানে বন্যা ও ঝড় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রধান কারণ, সেইসঙ্গে তাপপ্রবাহের প্রভাবও পূর্বের তুলনায় হয়েছে আরও তীব্র। এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশ যেন আরও চরম ঝুঁকির মুখোমুখি হতে চলছে। এই অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের দেশের যুবসমাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন বলে উল্লেখ করেছে বিশেষজ্ঞরা।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রাজধানীর সিক্স সিজনস হোটেলে এডুকো বাংলাদেশের আয়োজনে "যুব নেতৃত্বাধীন জলবায়ু কর্মসূচি: বর্তমান কৌশল, অনুশীলন এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা" শীর্ষক গবেষণা ফলাফল প্রকাশ ও মতবিনিময় সভার বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদা পারভিন। এসময় তিনি বলেন, জলবায়ু কর্মসূচি বাস্তবায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা হলো সাংস্কৃতিক বাঁধা। কারণ দেশের প্রবীণরা প্রায়ই তাদের প্রচলিত প্রথা এবং আচরণ পরিবর্তনে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রতিরোধ করেন। এর বিপরীতে যুবকরা অধিক গ্রহণযোগ্য এবং অভিযোজনমুখী, যা তাদেরকে সাংস্কৃতিক বাঁধা অতিক্রম করার জন্য মূল যোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সফলভাবে জলবায়ু কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়ক করে তোলে।
ফাহমিদা পারভিন বলেন, এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড় সাইক্লোনের ভয়াবহতা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। ১৯০১ সালে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ছিলো ২৫.১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সেটা ১২০ বছরে পরিবর্তিত হয়ে দাড়িয়েছে ২৬.১৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। অর্থাৎ এই সময়ে দেশের তাপমাত্রা ১.০২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পরিমাণ বেড়েছে। অপরদিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। ১৯০১ সালে ছিল ২৩৪৫ মিলিমিটার, এরপর কিন্তু বাড়েনি বরং কমেছে। কিন্তু এরপরও পূর্বের তুলনায় বন্যা বেশি হচ্ছে। এটার কারণ খুঁজে দেখা দরকার। এক্ষেত্রেও জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যায়। তবে আমি বলব ফ্লাশ ফ্লাডটাও (আচমকা পাহাড়ি বান বা পানির স্রোত) আমাদের বেশি হচ্ছে। এটাও বন্যার অন্যতম কারণ।
তিনি বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে আমাদের মতো দেশগুলোর ক্ষতি বেশি হচ্ছে। এই জলুবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে গত এক দশকে ৮ লাখ ৫০ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে এবং ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবং ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বন্যা এবং জলোচ্ছ্বাসে যে পরিমাণ কৃষির ক্ষতি হয়েছে, সেই কারণে ধানের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এটা কিন্তু পুরোটা কৃষিজমির ক্ষতির কারণে। এখন যেটি আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ আমাদের সী লেভেল রাইজটা (সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা) অনেকটাই বেড়ে যাবে। আমরা কিন্তু এর বাস্তব চিত্রও দেখতে পাচ্ছি। গত গত ২০ বছরে সী লেভেল রাইজ হয়েছে প্রায় ৮০ মিলিমিটার পর্যন্ত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক শঙ্কার কথা জানিয়ে আরও বলেন, দেশে লবণাক্ত পানির চাপটা ভূপৃষ্ঠে যত বাড়বে, নিচের সুপেয় পানিটা সেলাইন হয়ে যাবে, নদীর পানির লবনাক্ততা দিন দিন বাড়তে থাকবে। এরপর যখন বন্যা- জলোচ্ছ্বাস আসবে, ওই লবনাক্ত পানিটা জমিতে মিশে গিয়ে ধীরে ধীরে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে যাবে। তাই আমাদেরকে যথাসাধ্য প্রস্তুতির পাশাপাশি লবনাক্ত পানিতেই কী কী ফসল করা যায়, তা ভাবতে হবে। একইসঙ্গে কম বা বেশি পানিতেও কী কী চাষাবাদ করা যায় তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত গবেষণার অন্যতম প্রধান ফলাফল হলো, কিশোর-কিশোরী এবং যুবকেরা পরিবেশ সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকাসহ, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং প্রশমন কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। গবেষণাটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু কর্মসূচি বাড়ানোর জন্য অনুশীলন এবং নীতিগত সুপারিশ প্রদান করেছে এবং বর্তমান ও নতুন যুব জলবায়ু কর্মীদের সহায়তা করার জন্য সুপারিশ করেছে, যা বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো হ্রাস করতে সহায়ক হবে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, যুবসমাজকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে জলবায়ু সংকটের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলি হ্রাস করতে সহায়ক করতে 'ইয়থ এনভায়রনমেন্টাল স্টুয়ার্ডশিপ ফর ইকো-ফ্রেন্ডলি কমিউনিটিজ' নামক একটি প্রকল্প জুন ২০২৩ থেকে শরিয়তপুর জেলার জাজিরা এবং বরগুনা জেলার আমতলীতে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এডুকো বাংলাদেশ, নজরুল স্মৃতি সংসদ (এনএসএস) এবং শরিয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (এসডিএস) সহযোগিতায় এবং পোস্টকোড ফাউন্ডেশন ও বার্নফন্ডেন, সুইডেনের সহায়তায় এই প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে।
এর আগে স্বাগত বক্তব্যে এডুকো বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুল হামিদ যুব নেতৃত্বাধীন জলবায়ু কর্মসূচির উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বাংলাদেশের জলবায়ু উদ্যোগে যুবকদের অধিকতর সম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং একই সাথে অংশগ্রহণকারী ও গবেষণা দলের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনভায়রনমেন্টাল ক্লাব অফ বিইউপি'র উপদেষ্টা প্যানেলের চেয়ারপারসন ও যুব-জলবায়ু কর্মী মো. আবু রাহাত। এসময় তিনি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে যুবকদের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে জলবায়ু শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
টিআই/এমটিআই