সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধে পবার ৬ সুপারিশ

ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অযথা রেস্টুরেন্ট নির্মাণ ও নির্বিচারে গাছ নিধন বন্ধ করাসহ ৬ দফা সুপারিশ জানিয়েছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।
মঙ্গলবার (৪ মে) সংগঠনটি আয়োজিত উদ্যানটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এক অনলাইন আলোচনা সভায় এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়। গতকাল ৩ মে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃত্বে একটি দল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কর্মযজ্ঞ সরেজমিনে পরিদর্শন করে।
অন্য সুপারিশগুলো হচ্ছে- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিবেশ, তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, দৈনন্দিন পরিচালনা বিশ্বমানের করতে হবে। রমনা গ্রিন ধরে রাখতে হবে; জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে উদ্যানের জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক ভারসাম্য যেন নষ্ট না হয় এর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে; উদ্যানের স্থান ও পরিবেশ সংরক্ষণ করতে একটি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিতে হবে; উদ্যানে রেস্তোরাঁ, ওয়াকওয়ে কিংবা এ জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে অবিলম্বে জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে এবং উদ্যানসহ সব ঐতিহাসিক স্থাপনা বা এলাকার উন্নয়নের জন্য নগর পরিকল্পক, স্থপতি, শিল্পী, ইতিহাসবিদ, উদ্যানবিদ, প্রকৌশলী, শিক্ষক, পরিবেশবিদ ও কবি-সাহিত্যিক সব স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করতে হবে। যারা পরিকল্পনা থেকে শুরু করে উন্নয়ন কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন ও প্রয়োজনীয় মতামত দেবেন।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য উদ্যানকে ঘিরে বিভিন্ন রকম পরিবেশবিরোধী অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে গাছপালা কেটে ফেলায় প্রতিবেশের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ রমনা পার্ক এলাকা রাজধানীর ‘ফুসফুস’ হিসেবে চিহ্নিত। ইতিহাসের সাক্ষী সবুজের সমারোহ গাছ-গাছালির ছায়াঢাকা পাখিডাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দেশের নতুন প্রজন্ম, পরবর্তী প্রজন্ম বংশপরম্পরায় শত শত বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দেখবে এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বকে স্মরণ করবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত করেই ঢাকার এই খোলা ময়দানকে উন্মুক্ত রাখা সম্ভব। সবুজ প্রায় নিঃশেষিত উদ্যানটি আর যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
তারা আরও বলেন, রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঢাকার টিকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সবুজ বলয়ের একটি। এখানে প্রাচীন গাছ কেটে রেস্টেুরেন্ট ও ওয়াকওয়ে তৈরি করার নামে এটিকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এখানকার গাছপালা, বন্যপ্রাণী, বাস্তুসংস্থান, প্রতিবেশ সবকিছুকে সুরক্ষিত রেখেই এর উন্নয়ন করতে হবে। সংবিধান, পরিবেশ আইন এবং মানুষের সঙ্গে এর স্মৃতিময় সম্পর্ক সবকিছুর বিবেচনায় এরকম নৃশংস কাজ বন্ধ করা দরকার। এখানে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, নববর্ষ কতকিছুর ঐতিহাসিক স্মৃতি আছে। রেস্টুরেন্ট আর ওয়াকওয়ে কার জন্য? এখানে তো মানুষ মুক্ত অক্সিজেন নিতে আসে, সুস্থ হওয়ার জন্য শরীরচর্চা আর বিনোদনের জন্য আসে। উদ্যানের ভেতর কী ধরনের অবকাঠামো থাকবে তার একটি নীতিমালা দরকার। এটি একটি পাবলিক উদ্যান। এখানে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সমান হক আছে। এভাবে গাছ কাটা হলে গুল্ম, ফার্ন, ছত্রাক, লাইকেন, অণুজীব, পাখি, বেজি, কাঠবিড়ালি, সাপ, বাদুড়, প্রজাপতি, মৌমাছি, কেঁচোসহ নানা বন্যপ্রাণী চিরতরে তাদের বসত হারাবে। অযথা রেস্টুরেন্ট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে আইনি সহায়তা নিতে হবে।
বক্তারা আশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা চাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানটি যান্ত্রিক ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠুক। তবে উন্নয়ন হতে হবে উদ্যানের গাছপালা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে। উদ্যানের সবুজকে ধংস করে নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় শহরগুলোতে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে উদ্যান ও বড় ময়দানগুলোকে পুরোপুরি সংরক্ষণ করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের গৌরবের প্রতীক স্থান। ইকোসিস্টেম বজায় রেখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে একটি সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে তা বাস্তবায়িত হোক।
আলোচনায় যুক্ত ছিলেন ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশের (আইএবি) সাবেক সভাপতি ও স্থপতি অধ্যাপক শামসুল ওয়ারেস, পবা চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, পবার সম্পাদক ও গ্রিন ফোর্স সমন্বয়ক মেসবাহ সুমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন, নগর-পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান, পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আব্দুস সোবহান, স্থপতি ও আরবান ডিজাইনার, গবেষক, মোহাম্মদ জাকারিয়া ইবনে রাজ্জাক রাসেল, স্থপতি শাহিন আজিজ, লেখক, গবেষক পাভেল পার্থ, পবা’র সম্পাদক নীতি বিশ্লেষক ও আইনজীবী সৈয়দ মাহবুব আলম তাহিন, বানিপা’র সাধারণ সম্পাদক, এম এ ওয়াহেদ, পরিবেশকর্মী শামিমা জাহান প্রমুখ।
এমএইচএন/এফআর