সন্তানহারা মা-বাবার চোখের জলে ভিজলো শহীদ মিনার চত্বর
‘আন্দোলনে যাচ্ছি’— এই কথাটুকু বলে ৪ আগস্ট বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন মো. জুয়েল। তবে তার আর ঘরে ফেরা হয়নি। ওইদিন বিকেলেই যাত্রাবাড়ীর কাজলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে অংশ নিয়ে গুলিতে মারা যান তিনি।
অসুস্থ বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা মোবাইলের মাধ্যমেই জানতে পারেন— আদরের প্রিয় জুয়েল আর নেই। তিনি আর কোনোদিন তাদের কোলে ফিরবেন না। সকালে ঘর থেকে সুস্থ-সবল মানুষ বেরিয়ে গেলেও রাতে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ হয়ে ফিরেছেন। এমন ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে পুরো পরিবার।
বুধবার (১৪ আগস্ট) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে নিহত জুয়েলের বাবা সিরাজুল ইসলাম এভাবেই বলছিলেন সন্তান হারানোর কথা।
শুধু জুয়েলের পরিবারই নয় বরং সারা দেশ থেকে এ রকম অসংখ্য নাম জানা-অজানা স্বজন হারানো মানুষজন জড়ো হয়েছিলেন শহীদ মিনারের চত্বরে। যাদের মধ্যে কেউ হারিয়েছেন স্নেহের সন্তান, কেউ হারিয়েছেন আদরের ভাই-বোন। আবার কেউ হারিয়েছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। চোখের জল আর বুকফাটা কান্নায় তাদের স্মৃতিচারণ দেখে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয় পুরো শহীদ মিনার প্রাঙ্গণজুড়ে। কান্নাবিজড়িত কণ্ঠেই এসব হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানান স্বজনরা।
আরও পড়ুন
নিহত জুয়েলের বোন শারমিন সুলতানা বলেন, কাজলা ব্রিজে মিছিলে থাকাবস্থায় বিকেল সাড়ে ৫টায় পুলিশের গুলিতে জুয়েল আহন হয়েছিল। তখন আহত জুয়েলকে নিয়ে শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিকশাযোগে রওয়ানা দেয়। তবে পথেই মারা যায় জুয়েল। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পৌঁছার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, জুয়েল ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বেসরকারি একটি কোম্পানিতে টেকনিশিয়ানের চাকুরি করতেন। পরিবারের অসুস্থ বাবা-মা, ছোট ভাই, স্ত্রী এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে তার আয় দিয়েই জীবনযাপন করতো। আমরা এখন সর্বহারা ও অসহায় হয়ে গেছি। চোখের পানি ফুরিয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে বাবা-মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
শহীদ মিনার চত্বরেই ‘আমার ছেলে হাফিজুল সিকদার’— এমন ব্যানার নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন রিকশা চালক বাবা। তিনি বলেন, আমি গর্বিত আমার সন্তান অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আমার জীবনের সব আয় উপার্জন দিয়ে আমার সন্তানকে বড় করেছিলাম। আমার আদরের সন্তানকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।
পুলিশের গুলিতে নিহত টঙ্গীর সিরাজ উদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সামিউ আমান নূরের বড় বোন বলেন, আমাদের দুই বোনের একমাত্র ছোট ভাই নূর। মাত্র ১৩ বছর বয়স। এমন নির্মমতা তারা কীভাবে দেখাতে পারল? আমার আদরের ছোট ভাইকে কয়েকটি গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। যা বলার মতো ভাষা আমাদের জানা নেই। এই ঘটনার নিন্দা কীভাবে প্রকাশ করব তা জানি না। এই শোক সইতে পারছি না। আমার আদরের ছোট ভাইকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নয় বরং তাদের বিচারের ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।
এ সময় সাম্প্রতিক এই আন্দোলনে নিহত আরও অসংখ্য শহীদদের পরিবারের সদস্যরা স্মৃতিচারণ করেন। হত্যাকারীদের বিচারের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন ব্যানার ফেস্টুন প্রদর্শন করেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা। ‘ছাত্র জনতার রক্তের বিচার চাই’, ‘আবু সাঈদের রক্তের দাম দিতে হবে’, ‘হাসিনা স্বৈরাচারী’, ‘আওয়ামী লীগকে না বলুন’, ‘গুলির নির্দেশদাতাদের ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতেও দেখা যায়। একই সঙ্গে শেখ হাসিনাসহ দোষীদের দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তির মুখোমুখি করার দাবি জানান তারা।
আরএইচটি/এমজে