ঈদযাত্রায় যত বিপত্তি দক্ষিণের যাত্রীদের

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে চলমান বিধিনিষেধে রাজধানী ঢাকার সবকটি বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। তারপরও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে যে যেভাবে পারছেন ঘরমুখী হচ্ছেন।
ছোট ছোট বাহনে ঢাকা থেকে দেশের উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমের বিভিন্ন জেলার মানুষ মহাসড়ক ধরে ছুটে চলেছেন। রাতে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দূরের কিছু বাসও মহাসড়কে চলাচল করছে। সেই বাসেও যাচ্ছেন অনেকে। কিন্তু দক্ষিণের বিভিন্ন জেলার যাত্রীরা বড় ধরনের বিপত্তির মুখে পড়েছেন। তার মূল কারণ হঠাৎ ফেরি চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ। ফেরি পার হতে অপেক্ষমান মানুষের যাত্রা ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ফলে রোববার (৯ মে) সকাল থেকেই শিমুলিয়া, বাংলাবাজার, কাঁঠালবাড়িসহ বিভিন্ন ঘাটে যাত্রীদের অপেক্ষার প্রহর বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে ভোগান্তিও বাড়ে। জরুরি প্রয়োজনে চলাচল করা বিভিন্ন যানবাহনও আটকা পড়ে।
দক্ষিণ অঞ্চলে নৌপথে যাতায়াত করা যাত্রীরা বলছেন, ঈদযাত্রায় যত বিপত্তি যেন শুধুই তাদের। অন্য জেলার মানুষ গাড়িতে অনায়াসে বাড়ি যেতে পারছেন। শুধু তাদের ক্ষেত্রেই ফেরি বন্ধ যাত্রা ঠেকানোর চেষ্টা করছে সরকার। অথচ অন্যদিকে যাত্রা ঠেকাতে সরকারের তেমন কোনো নজরদারি নেই।
রহমত উল্লাহ নামের এক যাত্রী বলেন, বাড়ি গিয়ে ঈদ করার আনন্দই অন্যরকম। যত কষ্টই হোক পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে চাই। তাই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছি ফেরি পেতে। তিনি আরও বলেন, এখন যেভাবেই হোক বাড়ি যাচ্ছি। কিন্তু ঢাকায় ফেরার সময় যেন এ সমস্যা না থাকে। সরকারের কাছে ফেরি চালু করার দাবি জানাই।

দূরপাল্লার বাস চলাচলের অনুমতি নেই। তাতেও যাত্রা থেমে নেই। তারা ফেরি চালু থাকার সুযোগ নিয়েছেন। এক ফেরিতেই চেপে বসেছিলেন প্রায় ১২০০ যাত্রী। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর শুক্রবার কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় দিনে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখার। এরপরও সোমবার (১০ মে) সকালে প্রায় তিন হাজার যাত্রী নিয়ে শিমুলিয়া ঘাট ছাড়ে ফেরি যমুনা। ঘরমুখো মানুষের চাপ সামলাতে না পেরে বাধ্য হয়েই ফেরি ছাড়ে কর্তৃপক্ষ।
চলমান বিধিনিষেধের শুরু থেকেই মানুষ নানা অজুহাতে রাজধানী ছেড়েছেন। তবে ঈদ যত ঘনিয়ে আসে, রাজধানী ছাড়ার সেই প্রবণতা তত বাড়তে থাকে। ফলে বিভিন্ন ঘাটে ঘরমুখো মানুষের চাপ ছিল সব সময়ই। সেই চাপ যেন সর্বোচ্চ মাত্রা পায় শুক্রবার (৭ মে) ছুটির দিনে। সে দিন সকাল থেকেই যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ ছিল শিমুলিয়া ঘাটে। যার কারণে ফেরিতে কোনো যানবাহনই উঠতে পারেনি। ফেরি ঘাটে ভেড়া মাত্রই মানুষে কানায় কানায় ভরপুর হয়ে উঠেছিল।
ওইদিন সকাল ৮টার দিকে রো রো ফেরি এনায়েতপুরী কোনো যানবাহন ছাড়াই প্রায় ১২০০ যাত্রী নিয়ে বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশে রওনা দেয়। বেলা সোয়া ১১টার দিকে ফেরিটি শুধুমাত্র যাত্রী নিয়েই শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটে এসে পৌঁছায়। এক ফেরিতে প্রায় ১২০০ যাত্রী পরিবহনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে অল্প সময়ের মধ্যেই। তারপর শুক্রবার রাতে হঠাৎ দিনে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)।
ওই ঘোষণায় বলা হয়, পর দিন অর্থাৎ, ৮ মে (শনিবার) থেকে দিনে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে রাতে ফেরি চলাচল করবে। তাতে পণ্যবাহী যান পারাপার করা হবে। ঘোষণা অনুযায়ী, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি চলাচল দিনে বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু যাত্রীরা তীরে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরিতে ওঠায় বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ ফেরি ছাড়ছে যাত্রী নিয়েই। যদিও কর্তৃপক্ষ দিনে ফেরি চলাচলের বিষয়টি স্বীকার করছে না। অন্যদিকে যাত্রীদের দমাতে বিজিবি নামানোর পরও রোববার (৯ মে) ফেরিতে তারা বিভিন্ন নৌ-রুট পার হয়েছেন।

অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা ঢাকা থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে যাত্রীদের ঠেকাতে যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। তদুপরি ফেরি বন্ধ করে যাত্রীদের আটকে দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ, বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবছর ঈদযাত্রার আগে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হতো। এবার ঈদযাত্রায় বাধা দেওয়া হচ্ছে বিধিনিষেধের আদেশ জারি করে। তবে এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদফতরগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। ফলে ফেরি চালু রেখে আবার তা বন্ধ করা হচ্ছে। তাও করা হচ্ছে যাত্রীদের আগাম না জানিয়ে। এটা সমন্বয়হীনতার বড় উদাহরণ, এটা দেউলিয়াপনা। ফেরি ঘাটে কেন এত লোকের চাপ পড়বে? ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে তাদের বাধা দিলে হতো। সেই ব্যবস্থাপনা কেন নেই? সংকটে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবারও ধরা পড়ল। এটা সত্যি অনাকাঙ্ক্ষিত।
ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বিজিবি মোতায়েন হলেও রোববার মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে দুটি ফেরি প্রায় দুই হাজার যাত্রী নিয়ে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে পৌঁছে। এ দিন সকাল থেকে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে। বিজিবির বাধা সত্ত্বেও জোর করে ফেরিতে ওঠেন যাত্রীরা। শিমুলিয়া ঘাট থেকে সকাল ১০টার দিকে প্রায় দুই হাজার যাত্রী নিয়ে বাংলাবাজারের দিকে ছেড়ে যায় ফেরি শাহপরাণ। এর আগে ১১টি অ্যাম্বুলেন্স ও কিছু যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায় ফেরি ফরিদপুর। বাংলাবাজার ঘাট থেকে ফেরি দুটি আবার শিমুলিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। শিমুলিয়া ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় রোববার বিকেলেও বহু যাত্রী অপেক্ষায় ছিলেন।
রোববার সকাল থেকে শিমুলিয়া ঘাটে ছিলেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক সৈয়দ রায়হান। তিনি সকালে দুটি ফেরি ছেড়ে যেতে দেখেছেন। তারপর থেকে আরও হাজার হাজার যাত্রীকে তিনি ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছেন। তিনি জানান, এসব যাত্রীর কেউ ঢাকা, কেউ নারায়ণগঞ্জ, কেউ গাজীপুর থেকে শিমুলিয়া ঘাটে এসেছেন। বেশিরভাগ যাত্রীই দক্ষিণের বিভিন্ন জেলার। তার মধ্যে বেশি যাত্রী মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, ঝালকাঠির।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে লাশ ও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স পারাপারের জন্য কয়েকটি ফেরি চলাচল করছে। এসব ফেরিতে যাত্রী এবং ছোট গাড়িও পারাপার হচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকারি বিধিনিষেধ কাগজপত্রেই আছে। বাস্তবে নেই। বাড়ি যাওয়া বন্ধ করতে হলে এতদিন ফেরি চালু রাখা হয়েছিল কেন?
জানতে চাইলে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। ফেরিতে দিনে শুধু অ্যাম্বুলেন্স চলাচল করতে পারছে। দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন পাওয়া গেছে- এ তথ্য জানার পর আমরা আরও তৎপর হয়েছি। এ অবস্থায় আমরা ঈদ করতে বাড়ি যেতে পারি না। আমি নিজেও তো বাড়ি যাচ্ছি না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ঈদ করার জন্য। করোনার সংক্রমণ কমাতে ঈদে বাড়ি না গেলে কি হয়- এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, আমরা করোনা ছড়িয়ে দিতে পারি না। তাই দিনে ফেরিতে সাধারণ যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে না। অ্যাম্বুলেন্স পারাপার করা হচ্ছে।
শুক্রবার রাতে হঠাৎ দিনে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের এ ঘোষণা টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছে। যাত্রীরা ঘোষণা সম্পর্কে জানার পরও বাড়ির উদ্দেশ্যে কেন যাবে? তাদের সচেতন থাকা দরকার। আমরা হঠাৎ ঘোষণা দেইনি। আমরা যাত্রীদের আগে থেকেই বারবার অনুরোধ করেছি ঘাটে ভিড় না করতে।
পিএসডি/এসএসএইচ